ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়ে থাকলেও ক্ষুধা লাগে না?জানুন কোন ভিটামিন শরীরের ‘হাঙ্গার সিস্টেম’কে নিঃশব্দে চুপ করায়!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দীর্ঘ সময় না খেয়েও ক্ষুধা না লাগা, এটিকে অনেকেই হালকা বিষয় ভেবে এড়িয়ে যান। কেউ বলেন ব্যস্ততা, কেউ বলেন স্ট্রেস, কেউ আবার মনে করেন এটি অভ্যাসের কারণে ঘটে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, ক্ষুধা দীর্ঘসময় না লাগা বা খুব কম ক্ষুধা লাগা শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্ক সংকেত, এবং এর সঙ্গে বিশেষ কিছু ভিটামিন–ঘাটতির সম্পর্ক রয়েছে।মানবদেহে ক্ষুধাবোধ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস, হরমোন, পাচনতন্ত্র ও বিপাকীয় প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া যাতে ঠিকমতো কাজ করতে পারে, তার জন্য কিছু নির্দিষ্ট ভিটামিন অপরিহার্য।
যখন এই ভিটামিনগুলো কমে যায়, তখন-
☞ ক্ষুধাবোধ কমে যায়।
☞ খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে।
☞ দীর্ঘ না খেয়েও শরীর “ক্ষুধা সংকেত” পাঠায় না।
☞ ওজন কমে।
☞ শক্তি কমে।
☞ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়।
শরীরের ক্ষুধাবোধ কমে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন–চারটি ভিটামিন আছে, যেগুলো ঘাটতি হলে ক্ষুধা “অফ” হতে থাকে।
ভিটামিন বি১ (Thiamine),ক্ষুধা কমার সবচেয়ে সাধারণ কারণ:
মানুষের ক্ষুধা কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভিটামিন বি১ ঘাটতি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।
এটি শরীরের এনার্জি–মেটাবলিজম পরিচালনা করে। যখন বি১ কমে-
◑ শরীরে শক্তি উৎপাদন কমে যায়।
◑ স্নায়ু–ব্যবস্থার সংকেত দুর্বল হয়।
◑ হাইপোথ্যালামাস ক্ষুধা সংকেত ঠিকমতো পাঠাতে পারে না।
ফলে দীর্ঘ সময় না খেয়েও ক্ষুধা লাগে না।
বি১ ঘাটতির লক্ষণ:
⇨ খাবারের প্রতি অনাগ্রহ।
⇨ ক্ষুধাবোধ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
⇨ দুর্বলতা।
⇨ ক্লান্তি।
⇨ মাথা ঝিমঝিম।
⇨ বমিভাব।
যে খাবারে পাওয়া যায়: সুষম খাদ্য, বাদাম, দানা–জাতীয় খাবার, ডাল, ব্রাউন রাইস, ডিম।
ভিটামিন বি১২, ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে স্নায়ুর প্রভাব:
ভিটামিন বি১২ মূলত স্নায়ুতন্ত্র ও রক্তকণিকা তৈরি নিয়ন্ত্রণ করে।
এটি কমে গেলে ক্ষুধা কমে যায় কারণ-
◑ স্নায়ু দুর্বল হয়
◑ পাচনতন্ত্র ধীর হয়ে যায়
◑ গ্যাস্ট্রিক খালি হতে সময় নেয়
◑ ক্ষুধার সংকেত বন্ধ হয়ে যায়
ফলে অনেকেরই না খেলেও ক্ষুধা লাগেনা।
বি১২ ঘাটতির লক্ষণ:
⇨ ক্ষুধামন্দা।
⇨ মাথা ঘোরা।
⇨ হাত–পা ঝিনঝিনি।
⇨ হজম সমস্যা।
⇨ ওজন কমে যাওয়া।
যে খাবারে পাওয়া যায়: মাংস, ডিম, দুধ, দই, মাছ।
ভিটামিন ডি ঘাটতি, হরমোনের মাধ্যমে ক্ষুধায় প্রভাব:
ভিটামিন ডি শুধু হাড়ের জন্য নয়, হরমোনের সামঞ্জস্য, মুড ও ক্ষুধা–ব্যবস্থার সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত।
এটি কমে গেলে Serotonin নামের এক নিউরোট্রান্সমিটার কমে যায়। সারোটোনিন কমলে-
◑ ক্ষুধা কমে।
◑ খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে।
◑ মনমরা ভাব বাড়ে।
◑ ঘুম ব্যাহত হয়।
এ কারণেই অনেক সময় দীর্ঘদিন রোদ না পেলেও ক্ষুধা কমে যেতে দেখা যায়।
যে খাবারে পাওয়া যায়: মাছ, ডিমের কুসুম, দুধ, ফোর্টিফায়েড খাবার।
ভিটামিন সি, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে ক্ষুধা নষ্ট!
ভিটামিন সি-এর ঘাটতিতে শরীর দুর্বল হয়, ইমিউন সিস্টেম নেমে যায় এবং শরীরে প্রদাহের মাত্রা বাড়ে। ফলে মানুষের খাবারের আগ্রহ কমে যায়। বিশেষ করে—
◑ গলা ব্যথা
◑ মুখে ঘা
◑ অবসাদ
এসবের কারণে খাবারের প্রতি অনাগ্রহ বাড়ে, ক্ষুধা কমে যায়।
যে খাবারে পাওয়া যায়: লেবু, পেয়ারা, কমলা, কাঁচামরিচ, সবুজ শাকসবজি।
আয়রন ঘাটতি, ক্ষুধা কমে যায় কারণ শরীরের অক্সিজেন সরবরাহ কমে।
আয়রন কমে গেলে রক্তে অক্সিজেন পরিবহন কমে যায়। অক্সিজেন কম মানে শক্তি উৎপাদন কম। ফলে ক্ষুধা কমে যায়। অনেক সময় আয়রন ঘাটতির কারণে “Loss of Appetite” প্রধান প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়।
লক্ষণ:
◑ ক্ষুধামন্দা
◑ রক্তস্বল্পতা
◑ দ্রুত ক্লান্তি
◑ শ্বাসকষ্ট
◑ মাথা ঘোরা
যে খাবারে পাওয়া যায়: ডাল, পালং শাক, কলিজা, লাল মাংস, কুমড়োর বিচি।
ম্যাগনেসিয়াম ঘাটতি, হজমের সমস্যা এবং ক্ষুধা কমে যাওয়া!
ম্যাগনেসিয়াম পাচনতন্ত্রের মাংসপেশি ও স্নায়ুকে সক্রিয় রাখে। এটি কমে গেলে-
◑ পেট ভার
◑ ক্ষুধা কমে
◑ বমিভাব
◑ কোষ্ঠকাঠিন্য
ফলে সারাদিন খেতে ইচ্ছা করে না।
কেন খেতে ইচ্ছা করেনা ?
১. মস্তিষ্কের ক্ষুধা–সুইচ কাজ বন্ধ করে দেয়। ভিটামিন কমে গেলে হাইপোথ্যালামাস “হাংগার সিগন্যাল” পাঠায় না।
২. হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ঘ্রেলিন (ক্ষুধা বাড়ায়), লেপ্টিন (ক্ষুধা কমায়)। এই দুই হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
৩. পাচনতন্ত্র ধীর হয়ে যায়। খাবার দেরিতে হজম হয়,ফলে ক্ষুধা আসে না।
৪. মানসিক ক্লান্তি ক্ষুধাবোধ বন্ধ করে দেয়। ভিটামিন কমে গেলে মন–মেজাজ খারাপ হয়,এতে ক্রে ক্ষুধা কমে যায়।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা না খেয়েও ক্ষুধা না লাগা স্বাভাবিক নয়। এটি ইঙ্গিত দিতে পারে-
◑ অপুষ্টি।
◑ ভিটামিন ঘাটতি।
◑ দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রেস।
◑ হরমোন সমস্যা।
◑ থাইরয়েডের অস্বাভাবিকতা।
সুতরাং দীর্ঘসময় ক্ষুধা না লাগলে অবহেলা করা যাবে না।
যা করা উচিত-
☞ প্রতিদিন সুষম খাবার রাখা- ডিম, দুধ, মাছ, শাকসবজি, ফল -সব নিয়মিত খাওয়ানো উচিত।
☞ রোদে থাকা। ১৫–২০ মিনিট রোদ শরীরে ভিটামিন ডি সক্রিয় করে।
☞ অতিরিক্ত চা–কফি এড়িয়ে চলা। এগুলো খাবারের আগ্রহ কমায়।
☞ পর্যাপ্ত ঘুম।ঘুম কম হলে ক্ষুধা–হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
☞ নিয়মিত রক্তপরীক্ষা- বিশেষত বি১, বি১২, ডি, আয়রন পরীক্ষা জরুরি।
ক্ষুধা না লাগার পেছনে শরীরের লুকানো ঘাটতি থাকতে পারে, বিশেষ করে
ভিটামিন বি১, বি১২, ডি, সি এবং আয়রনের ঘাটতি। এসব ভিটামিন না থাকলে শরীরের ক্ষুধা–সংকেত নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘসময় ক্ষুধা না লাগা কখনোই স্বাভাবিক নয়। এটি শরীরের গভীর কোন অভাব বা দুর্বলতা বুঝিয়ে দেয়। তাই নিজের শরীরের সংকেত শুনুন। যদি দীর্ঘসময় ধরে ক্ষুধা কমে যায়, খাবার খেতে ইচ্ছে না করে। তাহলে এটিকে গুরুত্ব দিন, কারণ একটি ছোট ভিটামিন–ঘাটতি ভবিষ্যতে বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। সুস্থ ক্ষুধা মানেই সুস্থ শরীর আর সেই সুস্থতা আসে সঠিক পুষ্টি ও যত্ন থেকে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।