যে ভয় আমরা প্রতিদিন এড়িয়ে চলি-‘ট্র্যাকস’ দেখায়, সেটাই জয় করার একমাত্র পথ!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের ভেতরের ভয় আসলে কোথায় জন্ম নেয়? চারপাশের শব্দ থেমে গেলে যখন নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দই সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন মানুষ কি সত্যিই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে? বিশ্ব সাহিত্যে এবং বাস্তব অভিযানের ইতিহাসে ‘Tracks’ নামটি সেই প্রশ্নেরই এক বাস্তব উত্তর একটি দীর্ঘ যাত্রা যেখানে বিশাল মরুভূমির নির্জনতা, বালির ঢেউয়ের নীরবতা এবং নিজের ভেতরের অনিশ্চয়তাকে জয় করে এগিয়ে যাওয়া এক অসাধারণ মানবিক অভিজ্ঞতা জন্ম দেয়। এই গল্পটি শুধু একটা যাত্রার বিবরণ নয়; বরং মানুষের চরিত্র, মানসিক দৃঢ়তা, ভয়–অনুভূতির মনস্তত্ত্ব এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার গভীর অর্থকে নতুন করে ব্যাখ্যা করে। মরুভূমির মতো প্রতিকূল পরিবেশে প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল সংগ্রাম। কিন্তু সেই সংগ্রামই ধীরে ধীরে রূপ নেয় নিজের পরিচয় খুঁজে পাওয়ার যাত্রায়।
‘Tracks’-এর যাত্রা শুরু হয় অস্ট্রেলিয়ার বিচ্ছিন্ন, প্রান্তিক ও বিশাল মরুভূমি থেকে। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পরিবেশগুলোর একটি।যেখানে-
⇨ ৪৫ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা
⇨ অনন্ত দিগন্তে শুধু বালু
⇨ হঠাৎ উঠে আসা ধুলিঝড়
⇨ রাতের তীব্র নেমে যাওয়া ঠান্ডা
⇨ পানি ও খাদ্যের সংকট
এই পরিবেশ একটি মানুষের কাছে শুরুতেই মানসিক চাপে ফেলতে পারে। গবেষকদের ভাষায়, দীর্ঘসময় নির্জন পরিবেশে থাকা মানুষের মস্তিষ্কে-
◑ অ্যামিগডালা সক্রিয়তা বাড়ে (ভয় ও উদ্বেগের কেন্দ্র)।
◑ কর্টিসল নিঃসরণ বেড়ে যায়।
◑ হাইপারভিজিলেন্স তৈরি হয় (অতিরিক্ত সতর্ক অবস্থা)।
কিন্তু ঠিক এই জায়গাতেই দাঁড়ায় ‘Tracks’-এর মূল চরিত্র। নিজের ভয়কে বিশ্লেষণ করে, তাকে উপলব্ধি করে, তারপর ধীরে ধীরে তাকে জয় করার প্রক্রিয়া।
মানুষের ভয় কয়েকভাবে জন্মায়-
১। অজানা পরিবেশ।
২। শারীরিক বিপদের সম্ভাবনা।
৩। একাকিত্ব।
৪। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ।
মরুভূমিতে এ চারটিই একইসঙ্গে উপস্থিত। নিঃসঙ্গতার চাপ মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। মস্তিষ্ক তখন নিজের তৈরি কাল্পনিক বিপদও বাস্তব মনে করতে থাকে। রাতে ক্রমাগত শব্দ, বাতাসের সুরসুরানি, প্রাণীদের চলাফেরার ক্ষীণ আওয়াজ—সবই ভয়ের মাত্রা বাড়ায়। কিন্তু Tracks–এর যাত্রার বিশেষত্ব হলো ভয়কে অস্বীকার নয়, বরং ভয়কে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। এই মানবিক মনোভাবই গল্পটিকে আরও গভীর, বাস্তব ও শক্তিশালী করে।
মরুভূমিতে দীর্ঘপথ হাঁটার জন্য উট ছিল তার একমাত্র নির্ভরতা। উট শুধু বাহন নয়, এটি চলার সঙ্গী, নিঃসঙ্গতার মাঝে জীবন্ত উপস্থিতি, নিরাপত্তার প্রতীক এবং কঠিন সময়ে মনের জোর। প্রাণীর সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক বিশেষ করে কঠিন পরিবেশে চাপ সামলাতে সাহায্য করে। সাইকোলজিক্যালি এর নাম Companion Buffering Effect। অর্থাৎ, আশপাশে কাউকে পাওয়া মানেই মানসিক শক্তি বেড়ে যাওয়া।
মরুভূমিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পানির সীমাবদ্ধতা আর সূর্যের নির্দয় তাপ, এছাড়াও দূরত্বের বিশালতা, পথ হারানোর ভয়, শারীরিক ক্লান্তি। শরীরে এ ধরনের পরিবেশে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে-
◑ ঘাম দ্রুত বাষ্প হয়ে যায়।
◑ শরীর পানিশূন্যতায় ভোগে।
◑ স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে।
◑ পেশিতে টান লাগে।
◑ ইলেকট্রোলাইটের ঘাটতি হয়।
Tracks–এর যাত্রায় বুঝিয়ে দিয়েছে, মানুষের শারীরিক শক্তির চেয়ে মানসিক শক্তি বেশি কার্যকর। কারণ শরীর যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন মনই পথ দেখায়।
রাতে মরুভূমিতে তাপমাত্রা নেমে আসে প্রায় ১০–১২ ডিগ্রি পর্যন্ত। চারদিকে নীরবতা, অন্ধকার, রয়েছে অদৃশ্য প্রাণীর চলাচল, সাথে দূরের বাতাসের শব্দ! একাকিত্ব তখন ভয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু Tracks শেখায়, ভয়কে মুছে ফেলতে হলে ভয়কে চিনতে হয়। একা থাকা মানেই বিপদ নয় বরং স্বাভাবিক চিন্তাপ্রক্রিয়াকে নতুনভাবে গড়ে তোলার সুযোগও বটে। সাইকিয়াট্রি বলে, দীর্ঘ সময় একা থাকার অভিজ্ঞতা ব্যক্তিকে-
◑ গভীরভাবে আত্মপরিচয় খুঁজতে সাহায্য করে
◑ মানসিক স্থিতি বাড়ায়
◑ নিজের সঙ্গে কথা বলার জায়গা তৈরি করে
এই মানসিক রূপান্তরই তাকে ভয়কে নিজের শক্তিতে পরিণত করতে সাহায্য করেছে।
মরুভূমিতে দিগন্ত প্রায় একইরকম দেখায়। দিক নির্ধারণ খুব কঠিন। Tracks–এর যাত্রায় বারবার এই সংকট এসেছে—
কিন্তু সিদ্ধান্ত, যৌক্তিকতা এবং ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ তাকে নিরাপদ রেখেছে। মানুষের মস্তিষ্কে একটি বিশেষ অংশ আছে, Hippocampus।এটি নেভিগেশন এবং স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখে। কঠিন পরিবেশে এটি আরও সক্রিয় হয় এবং সংকেতগুলোকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে সাহায্য করে।
Tracks–এর অন্যতম আকর্ষক দিক হলো, লেখিকা বা যাত্রী মরুভূমিকে শুধু প্রতিকূল জায়গা হিসেবে দেখেননি। তিনি দেখেছেন—
⇨ বালুর ঢেউয়ের নকশা।
⇨ সোনালি আলো–ছায়ার খেলা।
⇨ রাতের আকাশে নক্ষত্রের বিস্তার।
⇨ নীরবতার ভেতরের শান্তি।
এগুলো মানুষের মনকে স্থির করে, গভীর চিন্তায় সাহায্য করে। শহরের শব্দমালায় যা পাওয়া যায় না, মরুভূমির নীরবতা সেই শান্তিই ফিরিয়ে দেয়।
ভয় জয়-মানসিক প্রশিক্ষণের তিন ধাপ!
Tracks–এর যাত্রা দেখায় ভয় জয় করার প্রাকৃতিক পদ্ধতি-
১. স্বীকার করা- ভয়কে অস্বীকার করলে চাপ বাড়ে। স্বীকার করলে মস্তিষ্ক শান্ত হয়।
২. বিশ্লেষণ করা- ভয়ের উৎস বোঝা গেলে তা কমে যায়। যেমন- “আমি একা আছি, তাই ভয় লাগছে, কিন্তু প্রকৃত বিপদ নেই।”
৩. একে একে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা- যত বেশি ভয়–সৃষ্ট পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়া যায়, ততই ভয় কমে।
এটি সাইকোলজির ভাষায় Exposure Therapy, যা ভয় কমাতে বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকর।
Tracks–এর কাহিনির বড় অংশ হলো নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপ। নিঃসঙ্গতা মানুষকে—
⇨ স্পষ্ট চিন্তা করতে।
⇨ নিজের ভুল–সঠিক উপলব্ধি করতে।
⇨ লক্ষ্য পরিষ্কার করতে।
সাহায্য করে।এটি মানবিক আত্মসচেতনতার এক গভীর অনুশীলন, যা শহুরে জীবনের তাড়াহুড়ায় প্রায় অসম্ভব।
‘Tracks’ মূলত স্বাধীনতার গল্প। একজন মানুষ নিজের সীমা ভেঙে, সমাজের প্রত্যাশা থেকে বেরিয়ে, প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করে যে নতুন পরিচয় তৈরি করে, এটাই গল্পটির প্রকৃত সৌন্দর্য। এটি প্রমাণ করে- মানুষ শুধু সমাজের অংশ নয়; সে প্রকৃতির অংশও এবং প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হলে মন আরও মুক্ত হয়।
‘Tracks’ আমাদের শেখায় ভয় মানেই হার নয় আর নিঃসঙ্গতা মানেই দুর্বলতা নয়। অজানা মানেই যে বিপদ তা কিন্তু নয়। মানুষের ভেতরের শক্তি সীমাহীন। মরুভূমির কঠোর পরিবেশ, ক্লান্তি, ক্ষুধা, শারীরিক দুর্বলতা সবকিছুর ওপরে ছিল অনমনীয় মানসিক দৃঢ়তা। এই যাত্রা প্রমাণ করে, মানুষ যখন নিজের ভয়কে চিনতে শেখে, তখন সে শুধু বেঁচে থাকতে পারে না বরং জীবনের গভীর অর্থও খুঁজে পায়। ‘Tracks’ তাই শুধু একটি পথচলার গল্প নয়। এটি মানুষের মনস্তত্ত্ব, আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা, এবং ভয় জয় করার এক অমূল্য বাস্তব পাঠ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।