শীতে ক্লান্তি–স্ট্রেস মিলিয়ে দিতে যে পানীয় তিনটি চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
শীত আসলে শুধু তাপমাত্রাই কমে না; কমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়, রক্তনালির সংকোচন বাড়ে, গলা–বুকের সংক্রমণ বেড়ে যায়, এবং মনেও আসে অলসতা ও ক্লান্তি। এই সময় এক কাপ গরম গ্রিন টি, চা বা কফি শুধু আরাম দেয় বলে আমরা ভাবি। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় এর আছে আরও গভীর ভূমিকা। শরীর গরম রাখা, রোগ প্রতিরোধ শক্তি টিকিয়ে রাখা, বিপাক প্রক্রিয়া সচল রাখা থেকে শুরু করে সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো সঠিক পরিমাণে গ্রিন টি, চা ও কফি শীতে প্রাকৃতিক সাপোর্ট সিস্টেমের মতো কাজ করে।
শীতে গ্রিন টির উপকারিতা-
গ্রিন টি হলো অপরিশোধিত চা–পাতা থেকে তৈরি এক ধরনের হারবাল পানীয়, যেখানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। শীতকালে এটি শরীরের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। গ্রিন টি–তে আছে ক্যাটেচিন (EGCG), পলিফেনল, ফ্ল্যাভোনয়েড। এই যৌগগুলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং ভাইরাস–ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শীতকালে সর্দি–কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বেশি হয়, গ্রিন টি তা কমাতে সহায়ক।
ঠান্ডায় বিপাক ধীর হয়ে গেলে গ্রিন টি সেটি বাড়ায়! শীতকালে শরীরের বিপাক ধীর হয়ে যায়, ফলে ক্লান্তি, অল্প কাজেই হাঁপিয়ে যাওয়া, ওজন বেড়ে যেতে পারে। গ্রিন টির EGCG + সামান্য ক্যাফেইন মিলে ফ্যাট অক্সিডেশন বাড়িয়ে শরীরের শক্তি উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে।
রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে হাত–পা ঠান্ডা কমায়। শীতে রক্তনালি সংকুচিত হয়, ফলে হাত–পা ঠান্ডা হয়। গ্রিন টির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তনালি শিথিল করে রক্ত চলাচল উন্নত করে।
গলা শুকিয়ে যাওয়া, গলা ব্যথায়ও উপকারী। গরম গ্রিন টি গলা আর্দ্র রাখে, প্রদাহ কমায়, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল হিসেবে কাজ করে, শীতের কাশি বা ঠান্ডায় আরাম দেয়।
মানসিক চাপ কমায়, ঘুমে সহায়তা করে (ডিক্যাফ সংস্করণে বেশি)! গ্রিন টি–তে আছে L-theanine নামক অ্যামিনো অ্যাসিড, যা মানসিক চাপ কমায়, মনোযোগ বাড়ায়, অতিরিক্ত উত্তেজনা হ্রাস করে, শীতকালে ডিপ্রেশন ও Seasonal Affective Disorder বাড়ে। গ্রিন টি মুড স্ট্যাবিলাইজারে ভূমিকা রাখে।
চায়ের (কালো চা/দুধ চা) শীতে স্বাস্থ্য–উপকারিতা!
চা শুধু সকাল–সন্ধ্যার পানীয় নয়। শীতকালে এটি দেহের তাপমাত্রা বজায় রাখা, সংক্রমণ রোধ ও মানসিক সজাগতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শরীর গরম রাখে, তাপ উৎপাদন বাড়ায়! কালো চায় ক্যাফেইন ও থিয়াফ্লাভিন রয়েছে, যা শরীরে তাপ উৎপাদন বাড়ায়, রক্তনালি উষ্ণ রাখে, ঠান্ডার কারণে কাঁপুনি কমাতে সাহায্য করে।
শীতে বেশি হওয়া বদহজম কমায়! উষ্ণ চা পেটের পেশি শিথিল করে, হজম সহজ করে, গ্যাস ও অ্যাসিডিটি কমায়, ঠান্ডায় হজম প্রক্রিয়া স্লো থাকে।এটি তা সক্রিয় করে।
অ্যান্টিভাইরাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান! চা–পাতায় থাকা পলিফেনল ভাইরাস–ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ধীর করে। শীতে সর্দি–কাশি কমাতে এটি সাহায্য করে।
মুড উন্নত করে! ঠান্ডায় মানসিক উদাসীনতা বা ক্লান্তি বাড়ে। এক কাপ গরম চা মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিন নিঃসরণ বাড়িয়ে মুডকে তাৎক্ষণিক উন্নত করে।
দুধ চা, বাড়তি পুষ্টি! দুধ থাকলে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন যোগ হয়, যা শীতে হাড়–জোড়ের ব্যথা কমাতে সহায়ক। তবে অতিরিক্ত দুধ চা,চিনি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
কফির স্বাস্থ্য–উপকারিতা!
কফি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গবেষিত পানীয়গুলোর একটি। এর স্বাস্থ্যগুণ শীতকালে আরও বেশি কার্যকর।
কফি শরীর গরম রাখতে সহায়তা করে। কফির ক্যাফেইন শরীরে থার্মোজেনেসিস বাড়ায়। অর্থাৎ শরীর নিজে তাপ উৎপাদন করে। এটি শীতের দিনে ঠান্ডা কমাতে সরাসরি সহায়ক।
মস্তিষ্ক সক্রিয় করে শীতের ক্লান্তি দূর করে। শীতে রোদ কম থাকায় মেলাটোনিন বাড়ে এবং মানুষ বেশি ঘুম পায়। কফি ডোপামিন ও নর–এড্রেনালিন সক্রিয় করে— মনোযোগ বাড়ায়, ঘুমঘুম ভাব কমায়, প্রতিক্রিয়া সময় দ্রুত করে। এ কারণে ঠান্ডা সকালে কফি বিশেষ কার্যকর।
শীতকালে বাড়তি ব্যথা (মাংসপেশি টান) কমাতে পারে। ঠান্ডায় পেশির সংকোচন বাড়ে। কফির ক্যাফেইন— রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়, ব্যথার অনুভূতি কমায় (হরমোনাল প্রভাব)। ফলে ব্যায়ামের পর পেশির ব্যথাও কিছুটা কমে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে প্রদাহ কমায়।কফিতে আছে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, পলিফেনল, যা পুরো দেহের প্রদাহ কমায়, বিশেষত শীতে যখন সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে।
ডিপ্রেশন ও শীতকালীন মনখারাপ কমাতে সহায়ক। কফি মস্তিষ্কে সেরোটোনিন, ডোপামিন, এন্ডোরফিন বাড়িয়ে মনখারাপ কমায়।
শীতে কতটা নিরাপদ? দৈনিক মাত্রা
গ্রিন টি: দিনে ২–৩ কাপ
চা: দিনে ১–২ কাপ (চিনি কম)
কফি: দিনে ১–২ কাপ (মোট ক্যাফেইন ২০০–৩০০ মি.গ্রা. এর বেশি নয়)
সতর্কতা!
◑ অতি ক্যাফেইন ঘুম কমায়।
◑ এসিডিটি থাকলে বেশি কফি–চা সমস্যা করতে পারে।
◑ অতিরিক্ত দুধ–চিনি স্থূলতা বাড়ায়।
◑ গর্ভাবস্থায় ক্যাফেইন কমাতে হয়।
◑ যারা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন তারা পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করবেন।
তবে নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে এগুলো সাধারণত নিরাপদ।
গ্রিন টি, চা ও কফি শুধু গরম পানীয় নয়, শীতকালের রোগ প্রতিরোধ, উষ্ণতা বজায় রাখা এবং মানসিক সজাগতার বৈজ্ঞানিক সঙ্গী। নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে এগুলো সংক্রমণ রোধ, বিপাক বাড়ানো, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করা, মনোযোগ বাড়ানো, হজম শক্তিশালী করা —সব দিক থেকেই শীতের জন্য আদর্শ পানীয়। শীতের সকালে এক কাপ চা–কফির পরশে শরীর গরম হওয়া, মন খুলে যাওয়ার যে অনুভূতি, তার পেছনে লুকিয়ে আছে বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম কাজ, যাকে আমরা প্রায়ই শুধু অভ্যাস বলে ভুল করে থাকি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।