ভিটামিন বি৬–আয়রনে ভরপুর এই ফলটি কেন হঠাৎ স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের নজর কাড়ছে?
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি, রক্ত তৈরির উপাদান এবং স্নায়ুতন্ত্রকে সচল রাখতে আমাদের প্রতিদিনকার খাবারের তালিকায় নানা ধরনের ফল থাকা জরুরি। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু ফল আছে যেগুলো নিয়ে এখনো অনেকের তেমন ধারণা নেই। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে ম্যামে সাপোটে (Mamey Sapote)। এটি মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের একটি অনন্য ফল, যার ক্রিমি টেক্সচার, প্রাকৃতিক মিঠে স্বাদ এবং উচ্চ পুষ্টিমান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ম্যামে সাপোটে আমাদের দেশে খুব প্রচলিত নয়, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এই ফল এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠছে। কারণ এর গুঁড়ো-নরম ভেতরের অংশ শুধু সুস্বাদুই নয়, বরং এতে রয়েছে ভিটামিন বি৬, আয়রন, পটাশিয়াম, ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট–সহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
ম্যামে সাপোটে মূলত মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো, কোস্টা রিকা, নিকারাগুয়া ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে প্রচলিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Pouteria sapota। বাইরের অংশ শক্ত বাদামি খোসায় আবৃত, কিন্তু ভেতরের গঠন নরম, ক্রিমের মতো মসৃণ এবং উজ্জ্বল লাল–কমলা রঙের।এই ফলের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো বাটার–স্মুথ কনসিস্টেন্সি।এটি কোনো রান্না ছাড়াই সরাসরি খাওয়া যায় এবং স্মুদি–ডেজার্ট–আইসক্রিমেও ব্যবহার করা হয়। গবেষকরা বলেন, এ ফলের টেক্সচার প্রাকৃতিকভাবে এমন পুষ্টিকণা ধরে রাখে যা হজমশক্তির জন্য অত্যন্ত উপকারী।
ম্যামে সাপোটে ছোট ও মাঝারি আকারের হলেও প্রতি গ্রামে পুষ্টিমানের ঘনত্ব বেশ বেশি। এর মধ্যে থাকে-
◑ ভিটামিন বি৬
◑ আয়রন (Iron)
◑ ফাইবার (Dietary Fiber)
◑ পটাশিয়াম
◑ ক্যাম্পারফেরল ও ক্যারোটিনয়েডস
◑ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
◑ ভিটামিন সি (পরিমিত পরিমাণে)
◑ স্বাস্থ্যকর কার্বোহাইড্রেট
এগুলো প্রত্যেকটি শরীরের বিভিন্ন মেটাবলিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সিন) আমাদের শরীরের মুড নিয়ন্ত্রণ, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম, হোমোসিস্টেইন নিয়ন্ত্রণ, হরমোন ব্যালান্স, রক্ত তৈরির প্রক্রিয়া —এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ম্যামে সাপোটের প্রতি পরিবেশনে বি৬-এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে উল্লেখযোগ্য। ফলে যাঁরা নিয়মিত এই ফল খান, তাদের মধ্যে ক্লান্তি কম হয়, স্ট্রেস–রিলেটেড হরমোনের ভারসাম্য উন্নত হয়, মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার কাজ আরও সক্রিয় থাকে। নিউট্রিশন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাকৃতিক বি৬–সমৃদ্ধ খাবার বেছে নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি, এবং ম্যামে সাপোটে সেই তালিকায় একটি শক্তিশালী নাম।
আয়রন হলো রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরির মূল উপাদান। পর্যাপ্ত আয়রনের অভাবে শরীরে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মনোযোগ কমে যাওয়া —এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ম্যামে সাপোটেতে উপস্থিত প্রাকৃতিক আয়রন শরীরে সহজে শোষিত হয়। ফলে এটি রক্তস্বল্পতায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্য উপকারী। মাসিকের সময় আয়রন–ঘাটতি পূরণে সহায়ক। শিশুদের শারীরিক বিকাশেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।দৈনন্দিন ক্লান্তি কমাতে ভূমিকা রাখে এটি। প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া আয়রনের সুবিধা হলো, অতিরিক্ত ঝুঁকি বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না।
ম্যামে সাপোটে উচ্চ পটাশিয়াম–সমৃদ্ধ ফল। পটাশিয়ামের কাজ-
⇨ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ।
⇨ হৃদপেশী মজবুত রাখা।
⇨ সোডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো।
যাঁদের হৃদরোগের ঝুঁকি আছে বা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এ ধরনের ইতিহাস রয়েছে, তাঁদের খাদ্যতালিকায় পটাশিয়াম–সমৃদ্ধ ফল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম্যামে সাপোটে তাই হৃদয়ের জন্য প্রাকৃতিক এক নিরাপদ সঙ্গী।
ম্যামে সাপোটে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, কোষ মেরামতি ও বয়স কমানোর সঙ্গী। এতে বিদ্যমান ক্যারোটিনয়েডস, ক্যাম্পারফেরল, ফেনলিক যৌগ শরীরে জমে থাকা ফ্রি–র্যাডিক্যাল কমাতে সাহায্য করে। ফলে কোষের ক্ষয় কমে, ত্বকের বয়স ধীরে বাড়ে, ক্যানসারের ঝুঁকিপূর্ণ কোষের গতি নিয়ন্ত্রণে থাকে, ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয় এবং নিয়মিত খেলে ত্বক হয় উজ্জ্বল, দেহ থাকে প্রাণবন্ত।
ফাইবার-হজম ও গাট–হেলথের জন্য অত্যন্ত উপকারী! ফাইবার হচ্ছে এমন একটি উপাদান যা—অন্ত্র পরিষ্কার রাখে।ভালো ব্যাকটেরিয়ার বাড়বাড়ন্ত ঘটায়। হজমকে সঠিক নিয়মে বজায় রাখে।গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির ঝুঁকি কমায়। ম্যামে সাপোটের ফাইবার বিশেষভাবে সলিউবল ও ইনসলিউবল—দু’ধরনেরই ভারসাম্য বজায় রাখে। ফলে এটি-
⇨ পেটের ভেতর পরিপূর্ণতা তৈরি করে
⇨ ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
⇨ রক্তের সুগার দ্রুত বাড়তে দেয় না
⇨ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যক্তিদের কাছেও এই ফলকে নিরাপদ বলা হয়।
ম্যামে সাপোটে খোসা ছাড়ালে ভেতর থেকে বের হয় ক্রিমি, মসৃণ, নরম, প্রাকৃতিক মিষ্টতায় ভরপুর একটি পাকা ফল খেতে মুখে শুধু ফলের স্বাদ নয়, বরং ভ্যানিলা, মধু এবং চকলেটের মিশ্র নরম ভাব অনুভূত হয়। এই বৈশিষ্ট্যই একে আন্তর্জাতিক রেঁস্তোরায় স্মুদি, আইসক্রিম ও ডেজার্ট তৈরিতে বিশেষ জনপ্রিয় করেছে।
যেভাবে খেলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়-
ম্যামে সাপোটে খাওয়া যায় বিভিন্নভাবে। যেমন-
⇨ সরাসরি ফল হিসেবে
⇨ স্মুদি হিসেবে
⇨ ওটস বা গ্রানোলার সঙ্গে
⇨ ফলের সালাদে
⇨ দুধের সঙ্গে শেক করে
⇨ ডেজার্টে
শিশুদের জন্য নরম পিউরি হিসেবে খাওয়ার আদর্শ সময়—সকালে বা দুপুরে, কারণ এ সময় শরীর পুষ্টি দ্রুত শোষণ করে।
উপকারিতা:
১. মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্র: ভিটামিন বি৬ ও কপার মিলে মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করতে সাহায্য করে। ফলে মনোযোগ বৃদ্ধি, স্ট্রেস কমানো, ঘুমের মান উন্নত হয়।
২. রক্ত ও হৃদযন্ত্র: আয়রন ও পটাশিয়াম একত্রে রক্ত উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়া হৃদপেশীকে শক্ত রাখে।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো সেল ড্যামেজ কমায়, ভাইরাস ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে।
৪. হজমতন্ত্র: ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়, অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায়।
৫. ত্বক ও সৌন্দর্য: ভিটামিন সি ও ক্যারোটিনয়েড ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়, উজ্জ্বলতা ধরে রাখে এবং বার্ধক্যের ছাপ কমায়।
সাবধানতা:
প্রাকৃতিকভাবে নিরাপদ হলেও-
⇨ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কেউ অতিরিক্ত পরিমাণে না খাওয়াই ভালো।
⇨ যাঁরা খুব কম ক্যালোরির ডায়েট মেনে চলেন, তাঁরা মাঝামাঝি পরিমাণে খেতে পারেন।
⇨ যেকোনো ফলের মতোই, অতিরিক্ত খেলে পেট ভার হতে পারে।
ম্যামে সাপোটে এমন একটি ফল, যেখানে আছে ক্রিমি স্বাদ, পরিপূর্ণ ফাইবার, ভিটামিন বি৬, আয়রন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম ইত্যাদি সব একসঙ্গে। খোসার ভেতরের গাঢ় কমলা অংশ শুধু সুস্বাদুই নয়, বরং শরীরের নানা গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমের জন্য উপকারী। পুষ্টিবিদরা বলছেন, এটি নতুন প্রজন্মের ‘ফাংশনাল ফুড’, যা শুধু ক্ষুধা মেটায় না; বরং শরীরের গভীরে স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন আনে। যারা প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর, ভিন্ন স্বাদের ফল যুক্ত করতে চান, ম্যামে সাপোটে হতে পারে এক অসাধারণ সংযোজন। প্রকৃতির এই মোলায়েম, মিষ্টি, পুষ্টিতে ভরপুর ফলটি সত্যিই এক লুকানো রত্ন; যার প্রতি কামড়ে রয়েছে স্বাস্থ্য ও স্বাদের নিখুঁত মিলন।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।