ডিজিটাল যুগে চোখের SOS-চাপ, ব্যথা আর ব্লার ভিশন থামাতে যেসব অভ্যাস বদলানো জরুরি!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
যখন আপনি এই লেখাটি পড়ছেন, আপনার চোখের সামনে স্ক্রিন আর স্ক্রিনই এখন আমাদের দিনের সবচেয়ে দীর্ঘ সঙ্গী। কাজের টেবিল, পড়াশোনা, মোবাইল সোশ্যাল ফিড, রাতের সিরিজ সব মিলিয়ে আমাদের চোখ কখন বিশ্রাম পাচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর অনেকেই দিতে পারবেন না। গত কয়েক বছরে বিশ্বের নানা দেশে চোখের চিকিৎসকদের কাছে একই অভিযোগ নিয়ে রোগীর সংখ্যা হঠাৎই বেড়ে গেছে চোখ জ্বালা, মাথাব্যথা, ব্লার ভিশন, ফোকাস করতে সমস্যা, ড্রাই আই, স্ক্রিন দেখলে চোখে ব্যথা, এমনকি ঘুমের ব্যাঘাতও। এগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ডিজিটাল আই স্ট্রেইন বা কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম, যা এখন আর শুধু কর্মজীবীদের সমস্যা নয়, স্কুলের শিশুরাও একই সমস্যার শিকার।
চোখের ওপর চাপ বাড়ার মূল কারণ স্ক্রিন নয়, আমাদের ব্যবহার পদ্ধতি!
চোখের গঠন অত্যন্ত সংবেদনশীল। আমাদের চোখ প্রতি সেকেন্ডে দৃষ্টির ফোকাস ঠিক করতে মাইক্রো–মুভমেন্ট করে। কিন্তু যখন আমরা স্ক্রিনে তাকাই, এই স্বাভাবিক ফোকাস করার প্রক্রিয়া চাপের মুখে পড়ে। কারণ, স্ক্রিনে থাকা আলোকরশ্মি স্থির নয় এবং চোখকে প্রতি মুহূর্তে সামঞ্জস্য করতে হয়।
স্ক্রিনে তাকালে মানুষ সাধারণত স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৬০% কম পলক ফেলে। ফলে চোখ শুকিয়ে যায়, চুলকানি হয়, কর্নিয়ার ওপর প্রটেকটিভ ফিল্ম পাতলা হয়, এমনকি দীর্ঘমেয়াদে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা দেখা দিতে পারে।
তাছাড়া দীর্ঘক্ষণ ব্লু–লাইট চোখের ক্লান্তিও বাড়ায়। এটি দৃষ্টির ফোকাস নষ্ট করে, ঘুমের হরমোন মেলাটোনিন নষ্ট করে, চোখের কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস সৃষ্টি করে। যদিও ব্লু–লাইট যে চোখ নষ্ট করে এমন কোনো সরাসরি প্রমাণ নেই। তবে ক্লান্তি ও চোখের ব্যথা বাড়ানোর প্রভাব নিশ্চিতভাবে দেখা যায়।চোখের জন্য আদর্শ স্ক্রিন থাকা উচিত চোখ থেকে ১৬–২৬ ইঞ্চি দূরত্বে, চোখের লেভেলের একটু নিচে।এগুলো না মানলে চোখ দ্রুত ক্লান্ত হয়, নেক–শোল্ডারও ব্যথা করে। আজকের প্রজন্মের চোখ সারাদিন ‘ন্যার–ভিশন’ এ কাজ করে, যাকে বলে নিঅর–ওভারলোড। এর ফলে চোখের পেশি ফোকাস ধরে রাখতে দ্রুত ক্লান্ত হয়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে-
১. ক্রনিক ড্রাই আই: চোখের স্বাভাবিক তৈলাক্ত ফিল্ম নষ্ট হয়ে যায়।
২. ব্লার ভিশন: স্ক্রিন থেকে উঠে দূরে তাকালে ঝাপসা দেখা।
৩. চোখের ব্যথা ও মাথাব্যথা:অতিরিক্ত ফোকাসিং পেশি ক্লান্ত হয়ে মাথার ব্যথা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
৪. নেক–শোল্ডার ও শরীরের ব্যথা: চোখের চাপ শরীরের ভঙ্গিমায় প্রভাব ফেলে।
৫. ঘুমের ক্ষতি: ব্লু–লাইটের কারণে মেলাটোনিন কমে গিয়ে ঘুমে সমস্যা হয়।
চোখ ভালো রাখতে বিজ্ঞানসম্মত অভ্যাস-
১. ২০–২০–২০ পদ্ধতি চোখের বিশ্রামের সেরা বৈজ্ঞানিক নিয়ম!প্রতি ২০ মিনিটে, ২০ ফুট দূরের কোনো জিনিসে, ২০ সেকেন্ড তাকাতে হবে। এটি ফোকাসিং পেশিকে আরাম দেয় ও চোখের চাপ অর্ধেকে নামিয়ে আনে।
২. স্ক্রিনের ব্রাইটনেস পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে নিন। যেখানে বসে আছেন তার আলো খুব উজ্জ্বল বা খুব কম হলে চোখকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।
৩. ডার্ক মোড রাতের সময় ব্যবহার করুন। দিনে নরম লাইট ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো, রাতে ডার্ক মোড চোখে চাপ কমায়।
৪. দীর্ঘসময় স্ক্রিনে কাজের মাঝে ৫–১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম দিন। চোখের লুব্রিকেশন ফিরিয়ে আনে।
৫. পানি কম পান করলে ড্রাই আই বাড়ে। হাইড্রেশন চোখের ভেতরের জলীয় স্তর ঠিক রাখতে মূল ভূমিকা রাখে।
চোখের দৃষ্টি স্থিতি ও ফোকাস উন্নত করতে কার্যকর ব্যায়াম-
এগুলো চোখের পেশির নমনীয়তা বাড়ায়, ফোকাস ধরে রাখার ক্ষমতা উন্নত করে এবং চোখে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়।
১. ‘পামিং এক্সারসাইজ’,চোখের গভীর শিথিলতা দেয়।
পদ্ধতি:
দুই হাত ঘষে গরম করে চোখ ঢেকে রাখুন। ৩০–৪৫ সেকেন্ড অন্ধকার উপভোগ করুন। দিনে ৩–৪ বার কুরুন।
উপকার:
চোখের স্নায়ু শান্ত হয়, ক্লান্তি কমে।
২. ফোকাস শিফট এক্সারসাইজ, চোখের ফোকাস শক্তিশালী করে।
পদ্ধতি:
একটি আঙুল নাকের সামনে রাখুন। প্রথমে আঙুলে তাকান। এরপর দূরের কোনো বস্তুর দিকে তাকান। এভাবে ১০–১৫ বার করুন।
উপকার: চোখের ফোকাসিং পেশি চর্চিত হয়, ব্লার ভিশন কমে।
৩. ‘ফার অ্যান্ড নিয়ার ফোকাস’,দূরদৃষ্টি–কাছের দৃষ্টি উভয়কে শক্তিশালী করে!
পদ্ধতি:
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরের কোনো স্থির বস্তুকে ১০ সেকেন্ড দেখুন। এরপর হাতের লেখা বা ফোনের লেখা ১০ সেকেন্ড দেখুন। ১০–১২ বার রিপিট করুন।
উপকার: চোখের লেন্স ও পেশির নমনীয়তা বাড়ায়।
৪. চোখ ঘোরানো (Eye Rotation):
পদ্ধতি:
চোখ ধীরে ঘড়ির কাঁটার দিকে ৫ বার, তারপর উল্টো দিকে ৫ বার মুভমেন্ট করুন।
উপকার:
রক্তসঞ্চালন বাড়ে, চোখের স্টিফনেস কমে।
৫. ব্লিঙ্কিং এক্সারসাইজ, ড্রাই আই প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর!
পদ্ধতি:
১০ বার দ্রুত পলক ফেলুন। ৫ সেকেন্ড চোখ বন্ধ রাখুন। দিনে অন্তত ৪–৫ বার।
উপকার:
চোখে প্রাকৃতিক লুব্রিকেশন বাড়ায়।
৬. ‘৮–শেপ মুভমেন্ট’, চোখের মুভমেন্ট দক্ষতা বাড়ায়!
পদ্ধতি:
বাতাসে একটি বড় ‘৮’ আঁকার মতো চোখ নড়ান ১০ বার করুন।
উপকার: চোখের পেশি শক্তিশালী হয়, ফোকাসিং মসৃণ হয়।
৭. সূর্যালোক থেরাপি (Morning Sun Exposure)! সকালের নরম সূর্যের আলো চোখকে সজীব রাখে। সকাল ৮টার আগে ২–৩ মিনিট সূর্যের আলোতে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ানো উপকারী।
খাবারের মাধ্যমে দৃষ্টি রক্ষা, যা সত্যিই চোখকে সহায়তা করে!
☞ ভিটামিন–A: গাজর, লাল–হলুদ ফল
☞ ওমেগা–৩: মাছ
☞ লুটেইন ও জিয়াজ্যানথিন: শাক, পালং, সবুজ সবজি
☞ ভিটামিন–C ও E: ফলমূল
☞ জিঙ্ক: বাদাম
এসব চোখের কোষকে অক্সিডেটিভ ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
চোখ কেন বাড়তি যত্ন চায়?
মানুষের চোখ তৈরি হয়েছে দূরের জিনিস দেখার জন্য। কিন্তু আধুনিক জীবন চোখকে উল্টো পথে চালাচ্ছে, সারাদিন কাছের স্ক্রিনে তাকানোর কারণে চোখকে অস্বাভাবিক চাপ নিতে হয়। অ্যাকোমোডেশন নামের যে প্রক্রিয়া চোখের ফোকাস ঠিক রাখে, সেটা সারাদিন সক্রিয় থাকলে চোখের পেশি ক্লান্ত হয়ে যায়। বয়স বাড়ার আগেই অল্প বয়সীদেরও ফোকাসিং পাওয়ার কমে যেতে দেখা যাচ্ছে, যাকে বলে অকাল প্রেসবায়োপিয়া। এ কারণেই চোখের যত্ন এখন শুধু প্রয়োজন নয়, অত্যন্ত জরুরি।
চোখ রক্ষার দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি:
☞ ঘুম ঠিক রাখা
☞ স্ক্রিন টাইম ২–৩ ঘণ্টা পর অবশ্যই ব্রেক নেওয়া
☞ ফোনে ছোট লেখা না পড়া
☞ রাতে শোবার আগে ১ ঘণ্টা স্ক্রিন এড়ানো
☞ ঘরে আর্দ্রতা বজায় রাখা
☞ ফ্যানের বাতাস সরাসরি চোখে না লাগানো
☞ চোখ ঘষা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা
মানুষের পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। তবুও সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। স্ক্রিনের যুগ আমাদের এগিয়ে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু চোখের ওপর বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে তিন–চার গুণ বেশি। এই সমস্যা কখনোই একদিনে তৈরি হয় না এবং একদিনে সমাধানও হয় না। যদি আমরা এখন থেকেই সচেতনভাবে স্ক্রিন ব্যবহার, নিয়মিত চোখের ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম, সঠিক খাবার এবং সঠিক অভ্যাস মেনে চলি, চোখকে অনেকদিন সুস্থ রাখা সম্ভব। চোখ আমাদের পৃথিবীর রঙ দেখায়, অন্য সব অগ্রগতির আগে চোখের স্বাস্থ্যই হওয়া উচিত নিজের প্রতি সবচেয়ে বড় যত্ন।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।