বিজ্ঞানীরা স্তব্ধ: ইউরোপার বরফচাদরে অস্বাভাবিক নড়াচড়া!-ক্লিপার মিশন কি উদঘাটন করবে লুকানো এক সমুদ্র–বিশ্ব?
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিছু অনুসন্ধান প্রশ্নের জন্ম দেয়, কিছু অনুসন্ধান উত্তর খুঁজে আনে। কিন্তু খুব কম অনুসন্ধানই এমন হয়, যা প্রশ্নকেও, উত্তরকেও নতুন মাত্রা দেয়। বৃহস্পতির বরফে ঢাকা রহস্যময় চাঁদ ‘ইউরোপা’। আর সেই রহস্যের পর্দা উন্মোচনে নাসার সাহসী মহাকাশযান-Europa Clipper। ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎক্ষেপণের পর থেকে যন্ত্রটির প্রতিটি সেকেন্ডই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানববিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানের দিকে!
বৃহস্পতির চারটি বড় চাঁদের একটি ইউরোপা প্রথম দেখায় শান্ত, বরফে ঢাকা, নিষ্প্রাণ। কিন্তু তার বরফ-ঢাকা স্তরের নিচে রয়েছে এক বিশাল লুকানো সমুদ্র, এমন প্রমাণ দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদের হাতে। অনুমান করা হয়, সেই সমুদ্র পৃথিবীর সব সমুদ্রের মোট পানির চেয়েও বেশি গভীর এবং বিস্তৃত। জীবনের অস্তিত্বের তিনটি মৌলিক শর্তগুলো, যেমন: পানি , রাসায়নিক উপাদান, এবং শক্তির উৎস ইউরোপায় থাকতে পারে। সৌরজগতের কোনো গ্রহ বা চাঁদে এই তিনটি উপাদান একসঙ্গে থাকার সম্ভাবনা এত বেশি আর কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি পৃথিবীর বাইরে কোথাও প্রথম জীবন খুঁজে পাওয়া যায়, সে জায়গাটি খুব সম্ভবত ইউরোপাই হবে।
নাসার Europa Clipper মহাকাশযান শুধু আরেকটি স্পেসক্র্যাফট নয়। এটি এমন এক মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, যা বরফ, সমুদ্র, চৌম্বকক্ষেত্র, রাসায়নিক উপাদান, জৈবিক পরিবেশ সবকিছুকে মিলিয়ে ইউরোপার সম্ভাব্য জীবনযোগ্যতা পরীক্ষা করবে। এই মিশনের লক্ষ্য সরাসরি জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করা নয়; বরং ইউরোপায় জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ আছে কি না এটি বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারণ করা।
মিশনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যগুলো-
◑ বরফ স্তরের নিচের সমুদ্র কত গভীর
◑ বরফের গঠন ও ঘনত্ব কেমন
◑ সমুদ্রের লবণাক্ততা ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য
◑ সমুদ্রের সঙ্গে বরফের আন্তঃক্রিয়া
◑ শক্তির উৎস আছে কি না
◑ সম্ভাব্য জৈব উপাদানের উপস্থিতি
◑ পৃষ্ঠের ফাটল, গহ্বর ও জলীয় প্লুমের অস্তিত্ব
এমন বিশদ অনুসন্ধানের আগে কোনো মহাকাশযান ইউরোপাকে এত কাছ থেকে দেখতে পারেনি।
Europa Clipper সাধারণ এক ফ্লাইটে যায় না। মহাকাশের জটিল গতি-প্রকৃতি ব্যবহার করে এটি ‘গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট’ নামে পরিচিত কৌশলে এগিয়ে যায়।
যাত্রার প্রধান ধাপ-
পৃথিবী থেকে প্রথমে মঙ্গলের নিকটে গিয়ে তার মাধ্যাকর্ষণ ব্যবহার করে বিশেষ ‘স্লিংশট’ পাওয়া। তারপর মঙ্গল থেকে পুনরায় পৃথিবীর কাছে ফেরত। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ আবার গতি বাড়ায়। তারপর পৃথিবী চূড়ান্ত ত্বরণে এগিয়ে গিয়ে বৃহস্পতির কক্ষপথে প্রবেশ। এভাবে ২.৯ বিলিয়ন কিলোমিটার অতিক্রম করে ২০৩০ সালের শুরুতে এটি বৃহস্পতির কক্ষপথে পৌঁছাবে। একই বছরের শেষের দিকে শুরু হবে ইউরোপার ওপর টানা ৪ বছর ধরে ৫০টিরও বেশি কাছাকাছি ‘ফ্লাই-বাই’।
কীভাবে কাজ করবে Europa Clipper?
Europa Clipper ইউরোপার কক্ষপথে স্থায়ীভাবে থাকবে না। কারণ বৃহস্পতির রেডিয়েশন এত তীব্র যে দীর্ঘমেয়াদে কোনো স্পেসক্র্যাফট তার মধ্যে টিকে থাকতে পারবে না। তাই এটি বৃহস্পতির চারপাশে কক্ষপথ ধরে ঘুরবে এবং সময় সময় ইউরোপার কাছ দিয়ে খুব নিচু উচ্চতায় উড়ে যাবে। প্রতিটি ফ্লাই-বাইই হবে এক একটি বৈজ্ঞানিক অভিযান—
⇨ কখনো বরফ স্তরের গভীরতা মাপা
⇨ কখনো চৌম্বকক্ষেত্র বিশ্লেষণ
⇨ কখনো বরফের ফাটল ও সম্ভাব্য প্লুমের ছবি তোলা
⇨ কখনো সমুদ্রের লবণাক্ততা ও বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা
এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হবে ইউরোপার সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক ডেটাবেইস।
Europa Clipper–এ রয়েছে নানা ধরনের উন্নত যন্ত্র যা একত্রে কাজ করে ইউরোপার গভীর বৈজ্ঞানিক রহস্য খুঁজে বের করবে।যেমন -
১. আইস পেনেট্রেটিং রাডার: বরফের বেশি নিচ পর্যন্ত রশ্মি পাঠিয়ে নির্ধারণ করবে, বরফের স্তর কত পুরু, কোথায় কোন অংশে তরল জল রয়েছে।
২. ম্যাগনেটোমিটার: চৌম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করবে সমুদ্র কতটা লবণাক্ত ও গভীর।
৩. অ্যানালাইসিস অফ প্লাজমা অ্যান্ড পার্টিকলস: ইউরোপার আশপাশের চার্জযুক্ত কণিকা পরীক্ষা করে বোঝা যাবে বরফ থেকে কি কোনো প্লুম বের হয়।
৪. হাই রেজোলিউশন ক্যামেরা: ইউরোপার পৃষ্ঠের গহ্বর, খাদ, বরফের রেখা, জলীয় উপাদান—সবকিছু অভূতপূর্ব বিস্তারিততায় তুলে আনবে।
৫. থার্মাল ম্যাপিং: বরফের নিচে কোথায় তাপ রয়েছে, কোথায় হয়তো ভূ-তাপীয় সক্রিয়তা আছে, তা বিশ্লেষণ হবে।
সব যন্ত্রই উচ্চ রেডিয়েশন–প্রতিরোধী ভল্টে রাখা হয়েছে, যাতে সেগুলো বৃহস্পতির তীব্র বিকিরণ সহ্য করতে পারে।
Europa Clipper–এর ফলাফল ভবিষ্যতে তিন ধরনের সিদ্ধান্ত এনে দিতে পারে-
➤ ইউরোপা সত্যিই ‘জীবনযোগ্য’! যদি স্থায়ী সমুদ্র, পর্যাপ্ত লবণাক্ততা, রাসায়নিক সমন্বয়, তাপ বা শক্তির উৎস পাওয়া যায়। তাহলে এটি হবে পৃথিবীর বাইরে প্রাণগঠনের সম্ভাব্য প্রথম প্রমাণ।
➤ ইউরোপা আংশিকভাবে জীবনযোগ্য! কিছু জায়গায় হয়তো প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সব শর্ত পূরণ নাও হতে পারে।
➤ ইউরোপা জীবনবিহীন পরিবেশ। এ ক্ষেত্রেও এটি মূল্যহীন হবে না। কারণ, এর মাধ্যমে জানা যাবে কেন পৃথিবীতে জীবন গঠিত হয়েছে আর অন্যত্র নয়।কিন্তু বিজ্ঞানীরা অধিকাংশই বিশ্বাস করেন ইউরোপা হবে আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে শক্তিশালী জীবনযোগ্য চাঁদ-এর প্রার্থী।
চ্যালেঞ্জ:
বৃহস্পতির রেডিয়েশন হলো সবচেয়ে বড় হুমকি। বরফ স্তর অস্বাভাবিক পুরু হওয়ায় রাডার সব সময় স্পষ্ট তথ্য দিতে নাও পারে।যোগাযোগ ব্যবস্থা জটিল, ডেটা পৃথিবীতে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগে। মিশনের সময়কাল দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরেরও বেশি। তবুও, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি ও নকশায় প্রতিটি ঝুঁকি মোকাবিলার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
Europa Clipper শুধু একটি মহাকাশযান নয়। এটি মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাচীন প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর— “আমরা কি সত্যিই একা?” যদি ইউরোপার বরফের নিচে মাত্র ক্ষুদ্রতম জীবাণুর অস্তিত্বের ইঙ্গিতও পাওয়া যায়, তাহলে সেই আবিষ্কার মানবসভ্যতার ইতিহাস বদলে দেবে।এতে জীবনের সংজ্ঞা বদলাবে, মহাবিশ্বে জীবনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে, ভবিষ্যৎ স্পেস মিশনের দিকনির্দেশ পাল্টাবে। এমনকি, ভবিষ্যতে ইউরোপায় রোবটিক সাবমেরিন পাঠানোর মিশনও সম্ভব হবে, সরাসরি সমুদ্রের ভিতরে গিয়ে নমুনা সংগ্রহের জন্য।
Europa Clipper এখন তার অভিযাত্রার মধ্যপথে। বহু বছরের প্রস্তুতি, প্রযুক্তিগত মেধা, এবং মানব কৌতূহলের সম্মিলনে তৈরি এই মহাকাশযান বহন করছে এক মহাকাশ-প্রশ্নের বোঝা— জীবন কি সত্যিই শুধু পৃথিবীর সম্পত্তি? ইউরোপার বরফের নিচে যদি থাকে স্থায়ী সমুদ্র, থাকে তাপ, থাকে রাসায়নিক গুণ, থাকে শক্তির উৎস, তবে সেখানে জীবনের জন্মের সম্ভাবনা অস্বীকার করার মতো নয়। আর সেই সম্ভাবনার দরজা খুলে দেওয়ার জন্যই, Europa Clipper এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত পথে। মানবজাতি তাকিয়ে আছে এই অভিযানের দিকে। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই আমরা জানতে পারব মহাজগতে আমরা একা নই।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।