ডিজিটাল ম্যাপে হঠাৎ ‘রেড অ্যালার্ট’-প্রযুক্তি কি আগেই ধরে ফেলছে সম্ভাব্য বিপদের ঠিকানা!

ডিজিটাল ম্যাপে হঠাৎ ‘রেড অ্যালার্ট’-প্রযুক্তি কি আগেই ধরে ফেলছে সম্ভাব্য বিপদের ঠিকানা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

প্রযুক্তি যত দ্রুত এগোচ্ছে, রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিধিও ততই বদলে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এখন শুধু মানবচোখ বা টহলদারি নয় ডেটার বিশাল জগত ও অ্যালগরিদমিক বিশ্লেষণই বহু দেশের নিরাপত্তা সিদ্ধান্তকে গাইড করছে। এই প্রযুক্তির নাম প্রেডিকটিভ পোলিসিং। বাংলায় ধারণাটি দাঁড়ায়-“অপরাধ ঘটার আগেই তার সম্ভাব্যতা নির্ণয়”।

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় এখন এমন মডেল তৈরি হচ্ছে যা পূর্বের অপরাধের তথ্য, মানুষের চলাফেরার ধরণ, সময়, মৌসুম, ঘনবসতি এলাকা, এমনকি সামাজিক আচরণগত ধারা মিলিয়ে নির্ধারণ করতে পারে- কোন এলাকায় কোন সময় ঝুঁকি বাড়তে পারে। প্রশ্ন হলো—এটি কি সত্যিই অপরাধ কমায়, নাকি নতুন ধরনের সামাজিক বৈষম্য ও নজরদারির জন্ম দেয়?

এই বিশাল বিতর্ক ঘিরেই তৈরি হলো এই প্রতিবেদন-যেখানে প্রেডিকটিভ পোলিসিং-এর ধারণা, বিজ্ঞান, সুবিধা-অসুবিধা, মানবাধিকার প্রশ্ন ও ভবিষ্যতের চিত্র সমগ্রভাবে তুলে ধরা হলো।

 

প্রেডিকটিভ পুলিশিং আসলে কী?

সাধারণভাবে, কোনো ঘটনার সম্ভাবনা গণনা করা আজ আর কঠিন কিছু নয়। আবহাওয়া পূর্বাভাস, যাতায়াতের ট্রাফিক প্যাটার্ন, বাজারের দাম সবকিছুই আজ আগেভাগে বলা যায়। সেই একইভাবে অপরাধের ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি চেষ্টা করছে একটা সম্ভাব্য সিগন্যাল দিতে। এর মূল ভিত্তি হচ্ছে—

◑ Crime Data: পূর্ববর্তী অপরাধের সময়, স্থান, পদ্ধতি

◑ Socio-behavioral Data: কোনো এলাকার জনসংখ্যা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষার মাত্রা, বেকারত্ব

◑ Geospatial Data: রাস্তাঘাট, আলো, জনসমাগম, বাজার, পরিবহন

◑ Temporal Pattern: সপ্তাহের দিন-রাত, মৌসুম, উৎসব বা ইভেন্ট

◑ Machine Learning Model: যেসব অ্যালগরিদম নানা চলক বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের অনুমান তৈরি করে। ফলে মডেল দেখাতে পারে- “শনিবার সন্ধ্যায় এই এলাকায় ছিনতাইয়ের ঝুঁকি বাড়তে পারে।” “এই পাড়ায় গাড়ি চুরির প্রবণতা আগামী মাসে বেড়ে যেতে পারে।”

এটি পুলিশকে সুযোগ দেয়- অপরাধ ঘটার আগেই সে এলাকায় টহল বাড়ানো, লাইটিং উন্নত করা, জরুরি সেবা প্রস্তুত রাখা এবং অনেক ক্ষেত্রে মানুষকেও আগে থেকেই সচেতন করা।
 

কেন এই প্রযুক্তি এত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে?

কারণ, এটি শুধু ‘অপরাধ কোথায় ঘটতে পারে’ বলেই থেমে নেই। কিছু মডেল নির্দিষ্ট ব্যক্তির আচরণগত প্যাটার্নও বিশ্লেষণ করছে। যেমন—

⇨ বারবার ছোটখাটো আইনভঙ্গ

⇨ অতীত রেকর্ড

⇨ মাদক বা গ্যাং-সংক্রান্ত এলাকায় বসবাস

⇨ সামাজিক আচরণ

⇨ অনলাইনে চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম
 

এই বিশ্লেষণ অনেক সময় মানুষের ওপর অপ্রত্যাশিত চাপ তৈরি করে। কেউ অপরাধ করেইনি তবুও তাকে অপরাধ-সম্ভাব্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে। সেখানেই তৈরি হয় সবচেয়ে বড় বিতর্ক- মানবাধিকার বনাম নিরাপত্তা!

 

প্রেডিকটিভ পোলিসিং-এর দুইটি প্রধান ধরন:

১) Place-based Prediction: এটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কিত। এখানে মানুষের নয়,স্থানের ঝুঁকি নির্ণয় করা হয়। উদাহরণ:

কোন এলাকায় বারবার স্ন্যাচিং হচ্ছে, কোন রাস্তায় রাত ৮টার পর ঘটনা বাড়ে, কোন বাজারে উৎসবের আগে-পরে পকেটমারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়! এই তথ্য পুলিশকে সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও টহল পরিকল্পনায় সহায়তা করে।

 

২) Person-based Prediction: এটি সবচেয়ে বিতর্কিত। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অপরাধে জড়াতে পারে, তা বিভিন্ন চলক বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করা হয়। সমালোচকরা বলেন, এতে জাতিগত পক্ষপাত, সামাজিক বৈষম্য, অযৌক্তিক নজরদারি, ভুল টার্গেটিং, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লঙ্ঘন -এসব ঝুঁকি থাকে।
 

Predictive policing-এর পেছনে যে অ্যালগরিদমগুলো কাজ করে, সেগুলো মূলত তিন ধরনের—

১) Statistical Hotspot Analysis- পূর্ববর্তী অপরাধের ডেটা ম্যাপ করে দেখা হয়, কোন এলাকায় পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা বেশি। এটি অনেকটা যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানেই আবার আগুন লাগার ঝুঁকি আছে- এরকম ধারা অনুসরণ করে।

২) Regression & Risk Modeling: বিভিন্ন চলক একসঙ্গে বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন আলোর ঘাটতি, জনসংখ্যার ঘনত্ব, বেকারত্ব হার, দোকানপাটের অবস্থান ইত্যাদি। এগুলো অপরাধের সম্ভাবনার সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কিত, এটাই বের করা হয়।

৩) Machine Learning Pattern Recognition: এটি আরও উন্নত। অপরাধ ধরন, সময়, মানুষের চলাচল, মোবাইল ডেটা, সিসিটিভি অ্যানালিটিকস সব একসঙ্গে বিশ্লেষণ করে প্যাটার্ন বের করে। এই ধরণের মডেল সময়ের সাথে আরও বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে।

 

কোনো দেশ কি এটি ব্যবহার করছে?

হ্যাঁ-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বহু দেশ বিভিন্নভাবে পরীক্ষা বা প্রয়োগ করছে।
তবে এ প্রযুক্তি নিয়ে বিতর্কও অনেক, ফলে অনেক দেশ সীমিত বা পরীক্ষামূলক পর্যায়েই আছে। নানা গবেষণা বলছে, কিছু এলাকায় এটি অপরাধ কমাতে কার্যকর হলেও, অন্য এলাকায় বৈষম্যমূলক নজরদারি আরও বেড়েছে। অর্থাৎ ফলাফল মিশ্র।

 

প্রেডিকটিভ পুলিশিং-এর সম্ভাব্য সুবিধা

১) টহলদারদের দক্ষতা বাড়ানো: পুলিশের লোকবল সীমিত। প্রতিটি এলাকায় সমান টহল দেওয়া যায় না। কিন্তু ডেটা যদি বলে দেয়, কোন সময় কোথায় ঝুঁকি বেশি। তাহলে পুলিশ যথাযথভাবে পরিকল্পনা করতে পারে।

২) অপরাধ প্রতিরোধে দ্রুত সিদ্ধান্ত: যদি জানা যায় নির্দিষ্ট এলাকায় মাদক-সম্পর্কিত ঘটনাবৃদ্ধি হচ্ছে, সেখানে আগে থেকেই নজরদারি বাড়ানো যায়।

৩) সাইবার অপরাধের পূর্বাভাস: ডেটা প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে মূলত ফিশিং অ্যাটাক, ভুয়া অ্যাপ, অনলাইন স্ক্যাম, আর্থিক জালিয়াতির প্রবণতা আগেই শনাক্ত করা যায়।

৪) বড় শহরের জটিল অপরাধব্যবস্থা বুঝতে সাহায্য: মেগা সিটিগুলোতে অপরাধের ধারা খুব জটিল। অ্যালগরিদমের বিশ্লেষণ সেখানে মানবচোখের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারে।
 

বিশ্বজুড়ে বহু গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি কোনো এলাকায় আগে থেকেই বেশি পুলিশি নজরদারি থাকে, সেখানে অপরাধের ডেটাও বেশি জমা হয়। ফলে অ্যালগরিদম সেই এলাকাকেই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেখায়, এটি একধরনের self-fulfilling loop।

কেউ অপরাধ করেনি তবুও অ্যালগরিদম যদি তাকে ঝুঁকিপূর্ণ দেখায়, তাকে কি নজরদারির আওতায় আনা উচিত? এই প্রশ্ন এখনও নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের মধ্যে একটি বড় দ্বন্দ্ব। আবার যে ডেটা ভিত্তি তা যদি অসম্পূর্ণ বা ভুল হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত আরও বিভ্রান্তিকর হতে পারে। অনেক মডেলের তথ্য উৎস, চলক, ওজন এসব প্রকাশ করা হয় না। ফলে সাধারণ মানুষ জানতেই পারে না কোন যুক্তিতে তাকে ‘রিস্ক স্কোর’ দেওয়া হলো।

বাংলাদেশে গণপরিবহন, নগরায়ণ, ঘনবসতি, তরুণ জনসংখ্যা সব মিলিয়ে জটিল নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ আছে। আরও আছে দ্রুত ডিজিটালাইজেশন, মোবাইল ব্যবহার, অনলাইন লেনদেন বৃদ্ধি।প্রেডিকটিভ পোলিসিং ভবিষ্যতে-

⇨ মেট্রোপলিটন এলাকায় টহল পরিকল্পনা

⇨ উৎসব-অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা

⇨ সাইবার জালিয়াতি প্রতিরোধ

⇨ নারী ও শিশু নিরাপত্তা

⇨ আর্থিক অপরাধ বিশ্লেষণ

এসব ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। তবে প্রযুক্তি ব্যবহারের সাথে নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও সমান জরুরি।

 

মানবাধিকার ও প্রযুক্তির মধ্যে ভারসাম্য কেমন হওয়া উচিত?

বিশ্বজুড়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- 

◑ ডেটার উৎস স্বচ্ছ হতে হবে

◑ কোনো ব্যক্তিকে শুধুমাত্র অ্যালগরিদমের ওপর ভিত্তি করে টার্গেট করা যাবে না

◑ মানবিক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হতে হবে, প্রযুক্তি কেবল সহায়ক

◑ আইনি কাঠামো ও নজরদারি প্রয়োজন

◑ বৈষম্য তৈরি হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য, অ্যালগরিদম নিয়মিত অডিট করতে হবে।

প্রযুক্তি কখনোই মানুষের বিবেচনাকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না বরং তাকে আরও তথ্যসমৃদ্ধ করতে পারে।

 

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভবিষ্যতে-

⇨ সিসিটিভির লাইভ ভিডিও AI অ্যানালিটিকস

⇨ জনসমাগমের আচরণ বিশ্লেষণ

⇨ রিয়েল-টাইম ট্রাফিক ও মুভমেন্ট প্যাটার্ন

⇨ ড্রোন নজরদারির ডেটা

⇨ অনলাইন জালিয়াতির predictive model
 

এসব একসঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও শক্তিশালী ক্রাইম অ্যানালিটিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি হতে পারে। তবে এর সাথে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, গোপনীয়তা, ডেটা নিরাপত্তা সবই হবে নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রীয় বিষয়।

 

প্রেডিকটিভ পুলিশিং ‘সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী’ নয় এটি ‘সম্ভাবনার বিশ্লেষণ’ মাত্র। মানুষের আচরণ কখনোই ১০০% পূর্বাভাসযোগ্য নয়। তবে প্রযুক্তি যদি দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা যায়, স্বচ্ছতা ও মানবিকতার সাথে, তাহলে এটি অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর সহায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রণ ছাড়া প্রযুক্তি যদি মানুষের ওপর অযাচিত নজরদারি ও বৈষম্যের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তাহলে তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। অপরাধ মোকাবিলায় তাই  প্রযুক্তির গতি, মানবিকতার গভীরতা, এবং নীতির দৃঢ়তা—এই তিনের সমন্বয় প্রয়োজন।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ