কিডনি সুস্থ রাখতে প্রতিদিনের থালায় থাকা উচিত যে ৫টি খাবার-পুষ্টিবিজ্ঞানে উঠে আসছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানবদেহে কিডনি এমন একটি অঙ্গ, যা দিন-রাত বিরামহীনভাবে রক্ত ছেঁকে, পানি–লবণের ভারসাম্য ধরে রাখে এবং শরীরের বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি সাধারণত নীরবই থাকে- ব্যথা, জ্বালা বা তীব্র কোনো সংকেত দেয় না। ঠিক এই নীরবতার কারণেই যখন সমস্যা ধরা পড়ে, তখন তা অনেক সময়ই বেশ দেরিতে হয়। বিশ্বজুড়ে কিডনি রোগ ক্রমেই বাড়ছে। খাদ্যাভ্যাস, লাইফস্টাইল, লবণ-চিনি-প্রসেসড খাবারের অতিরিক্ত গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া সব মিলিয়ে কিডনি যে চাপের মুখে, তা বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন। তবে সুসংবাদ হলো, সঠিক খাবার নির্বাচন কিডনিকে শুধু সুরক্ষাই দেয় না, এর কাজকে সহজ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। কিডনির জন্য উপকারী খাবারগুলো সাধারণত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, কম সোডিয়ামযুক্ত, পানি ধারণে সহায়ক এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
১) আপেল, কিডনির জন্য প্রাকৃতিক ডিটক্স সহায়ক:
দৈনন্দিন ফলগুলোর মধ্যে আপেল কিডনির জন্য অসাধারণ উপকারী। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার, ফ্ল্যাভোনয়েড, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন–সি, যা দেহের প্রদাহ কমায় এবং রক্তে জমা অবাঞ্ছিত উপাদানগুলোর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
কেন আপেল কিডনির বন্ধু?
আপেলের দ্রবণীয় ফাইবার রক্তের চিনি ও কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে, যা কিডনি নষ্ট হওয়ার দুই বড় ঝুঁকিকে নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে থাকা পলিফেনল অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়, ফলে কিডনির ফিল্টারিং প্রক্রিয়ায় চাপ কম পড়ে। আপেল পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরের স্বাভাবিক ডিটক্স প্রক্রিয়াকে সহজ করে। নিয়মিত একটি আপেল কিডনির ফিল্টারিং ক্ষমতা ঠিক রাখতে সহায়তা করে, এটি বহু গবেষণায় আলোচিত।
২) ওটস, রক্তচাপ ও শর্করা নিয়ন্ত্রণে এনে কিডনিকে দেয় স্থিতি:
ওটস বা ওটমিলকে অনেকে শুধু ডায়েট খাবার মনে করেন, কিন্তু কিডনি সুস্থ রাখার ক্ষেত্রেও এটির প্রভাব বিশাল। এতে রয়েছে বিটা-গ্লুকান নামক বিশেষ এক ধরনের দ্রবণীয় ফাইবার।
কেন ওটস কিডনি রক্ষায় ভূমিকা রাখে?
বিটা-গ্লুকান রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে, যা কিডনি রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত জরুরি। এটি রক্তে গ্লুকোজ শোষণের গতি কমায়, ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর ডায়াবেটিস হলো কিডনি নষ্ট হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। ওটস দেহে পানি ধরে রাখে, যার ফলে কিডনির বর্জ্য ছাঁকনিতে সাহায্য হয়। কম সোডিয়াম ও উচ্চ ফাইবার হওয়ায় কিডনির ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়ে না। সকালের নাস্তায় এক বাটি ওটমিল কিডনির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যের পক্ষে অন্যতম সেরা খাদ্যাভ্যাস।
৩) শসা, দেহে পানির ভারসাম্য ঠিক রেখে কিডনিকে রাখে চনমনে:
শসা প্রায় ৯৫% পানি, যা কিডনির কাজকে সবচেয়ে বেশি সহজ করে এমন একটি বৈশিষ্ট্য। কিডনি আসলে তরলবহুল খাবার ও পানিতে বেশ স্বস্তিতে থাকে, কারণ এতে রক্ত তরল হয় এবং ফিল্টার করার বোঝা কমে যায়।
শসা কেন কিডনির জন্য এত মূল্যবান?
উচ্চ পানি উপাদান মূত্রের পরিমাণ বাড়ায়, যা স্বাভাবিকভাবেই টক্সিন দূর করে। কম সোডিয়ামযুক্ত হওয়ায় শসা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শসায় থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নিয়মিত শসা খেলে কিডনিতে লবণ জমাট বাঁধার সম্ভাবনা কমে, ফলে স্টোন হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়। গরম আবহাওয়ার দেশগুলিতে শসাকে প্রাকৃতিক হাইড্রেটর বলা হয়, যা কিডনির জন্য সত্যিকার অর্থেই গুরুত্বপূর্ণ।
৪) ফুলকপি, কিডনি-সুরক্ষায় ‘লো-পটাশিয়াম’ সবজির রাজা!
কিডনি সমস্যায় সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো সোডিয়াম ও পটাশিয়াম নিয়ন্ত্রণ। ফুলকপি এখানে নিরাপদ সবজি হিসেবে শ্রেষ্ঠ। এতে রয়েছে ভিটামিন–সি, কে, বি-কমপ্লেক্স, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
কেন ফুলকপি কিডনির জন্য এত উপকারী?
এতে পটাশিয়াম কম, তাই কিডনির ওপর বাড়তি চাপ ফেলে না। ফুলকপির সালফার যৌগ দেহের টক্সিন ভাঙতে সাহায্য করে। এটি অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, দীর্ঘমেয়াদি কিডনি প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। কম ক্যালোরি ও উচ্চ ফাইবার হওয়ায় ফুলকপি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। অতিরিক্ত ওজনও কিডনি ক্ষতির আরেক ঝুঁকি। ফুলকপি সিদ্ধ, ভাজা বা তরকারিতে সবভাবেই খাওয়া যায় এবং সহজেই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় যুক্ত করা যায়।
৫) জলপাই তেল, কিডনিকে রক্ষা করা স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের অন্যতম উৎস:
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট কিডনির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো প্রদাহ কমায় এবং দেহের কোষগুলোর ক্ষয় রোধ করে। জলপাই তেল বা অলিভ অয়েল সেই দিক থেকে কিডনির জন্য একটি আদর্শ খাবার।
কেন জলপাই তেল কিডনির বন্ধু?
অসম্পৃক্ত ফ্যাট রক্তের LDL কোলেস্টেরল কমায়, যা কিডনির রক্তনালীগুলোকে সুরক্ষিত রাখে। এতে থাকা পলিফেনল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহে আপেক্ষিক প্রদাহ কমিয়ে কিডনির চাপ হ্রাস করে।অলিভ অয়েল ক্যালোরি-ঘন হলেও কিডনির জন্য নিরাপদ। কারণ, এতে সোডিয়াম নেই এবং চর্বি কোষ জ্বালাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। অলিভ অয়েল খাদ্য হজমে সাহায্য করে, ফলে বর্জ্যপ্রসেসিং সহজ হয়, যা কিডনির কাজকে সুবিধা দেয়। রান্নায় কম তাপে ব্যবহার করা অথবা সালাদের সাথে মিশিয়ে খাওয়া- দুইভাবেই এটি কিডনির জন্য কার্যকর।
কিডনি সুস্থ রাখতে অতিরিক্ত কিছু অভ্যাস!
যদিও খাবার গুরুত্বপূর্ণ, তবে কেবল খাদ্যাভ্যাসই কিডনিকে সুরক্ষিত রাখতে যথেষ্ট নয়। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, কয়েকটি অতিরিক্ত অভ্যাস কিডনির কাজকে স্থিতিশীল করে:
◑ প্রতিদিন কমপক্ষে ৬–৮ গ্লাস পানি পান।
◑ অতিরিক্ত লবণ, অতিরিক্ত চিনি, প্রসেসড খাবার কম খাওয়া।
◑ অ্যালকোহল ও ধূমপান এড়ানো।
◑ নিয়মিত হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম।
◑ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
◑ দেহে পানি কমে গেলে সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করা।
এই অভ্যাসগুলো কিডনির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর।
দৈনন্দিন ট্রেন্ডিং ডায়েট, বারবার পরিবর্তনশীল খাদ্যাভ্যাস এবং প্রসেসড খাবারের সহজলভ্যতার যুগে কিডনি যে সবচেয়ে বড় চাপে আছে, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ প্রতিদিনের থালায় থাকা কয়েকটি সাধারণ খাবারই পারে কিডনিকে অনেক সমস্যার থেকে বাঁচাতে। আপেল, ওটস, শসা, ফুলকপি এবং জলপাই তেল- এই পাঁচটি খাবারের বৈশিষ্ট্য হলো: এগুলো প্রদাহ কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, দেহে পানি ভারসাম্য ঠিক রাখে এবং কিডনির ফিল্টারিং প্রক্রিয়াকে সহজ করে।।কিডনির কাজ বাইরে থেকে দেখা যায় না কিন্তু ভুল খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন ধীরে ধীরে তাকে দুর্বল করে তোলে। তাই বরং আজ থেকেই অভ্যাসে আনুন এমন খাবার, যা কিডনিকে দীর্ঘমেয়াদে সুরক্ষা দেবে। কারণ সুস্থ কিডনি মানেই দেহের সুষম কার্যক্রম, ভারসাম্যপূর্ণ জীবন এবং দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা বৃদ্ধি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।