শিক্ষার নতুন দিশা-ইকুয়েডরের গোলাপ-ভিত্তিক প্রজেক্ট দেখে অবাক সবাই!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ ইকুয়েডর শুধু আগ্নেয়গিরি, অ্যান্ডিজ পাহাড় বা আমাজনের রেইনফরেস্ট দিয়েই বিখ্যাত নয়,এই দেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ গোলাপ রপ্তানিকারক। এখানকার গোলাপের রঙ, ঘনত্ব, পাপড়ির স্থায়িত্ব এবং উচ্চ জমির সূর্যালোক সবকিছুই একে আলাদা স্থানে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু গত এক দশকে ইকুয়েডর এমন একটি পথ বেছে নিয়েছে, যা তাকে শুধু ‘গোলাপ উৎপাদনের কেন্দ্র’ নয়, বরং পরিবেশবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থার মডেল দেশ হিসেবে নতুন পরিচিতি দিচ্ছে। এই নতুন উদ্যোগের নাম Sustainable Rose Education। এটি এমন একটি শিক্ষা ধারণা, যেখানে গোলাপচাষ, কৃষি–প্রযুক্তি, জলবায়ু সচেতনতা, মাটির বিজ্ঞান, পানি ব্যবস্থাপনা, পোকা–নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য পুনর্ব্যবহার সবকিছুকে শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যবইয়ের মধ্যে না রেখে শিক্ষার্থীদের হাতে–কলমে শেখানো হয় বাস্তব খামারের ভেতরে।
ইকুয়েডরে গোলাপচাষ একটি কোটি–ডলারের শিল্প। পুরো দেশের অর্থনীতিতে কৃষিভিত্তিক ফুলচাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু দীর্ঘদিন এ খাতে অতিরিক্ত পানি ব্যবহার, রাসায়নিক সার, কীটনাশকের অপব্যবহার, মাটির ক্লান্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি- এসব সমস্যা তৈরি করেছিল। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন গোলাপ উৎপাদনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। অনিয়মিত বৃষ্টি, খরা, জন্মানো রোগ–পোকার বদল, উৎপাদনশীলতার ওপর চাপ বাড়ছিল। এই সময়ে সরকার, স্থানীয় উদ্যোক্তা ও শিক্ষা গবেষকরা মিলিত হয়ে বলেন, “যদি ভবিষ্যত প্রজন্মকে টেকসই কৃষির শিক্ষা দেওয়া না যায়, তাহলে ফুলচাষ টিকে থাকবে না।” ফলে জন্ম নেয় Sustainable Rose Education, একটি দেশের কৃষি ও শিক্ষাকে নতুনভাবে মিলিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ।
এই শিক্ষা ব্যবস্থা চারটি মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে:
⇨ পরিবেশবান্ধব গোলাপচাষ শেখানো।
⇨ প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট কৃষি বুঝানো।
⇨ শিক্ষার্থীদের বাস্তব খামার পরিচালনায় যুক্ত করা।
⇨ দায়িত্বশীলতা ও পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলা
এই ধারণাটি বিশ্বাস করে- “মাটি, ফুল, পানি, আলো এগুলো বইয়ের মধ্যে শেখানোর বিষয় নয়; মাঠে গিয়ে অনুভব করার বিষয়।” তাই এখানে শিশুরা শুধু ফুলের চাষ শেখে না। তারা শেখে মাটিকে সম্মান করা, পানি বাঁচানো, প্রকৃতির সঙ্গে কাজ করা এবং টেকসই ভবিষ্যত গড়ার পরিকল্পনা।
ইকুয়েডরের বহু বিদ্যালয় ও কৃষিভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন গোলাপ ফার্মের সঙ্গে অংশীদারিত্বে কাজ করছে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ে গোলাপের চারাকে কীভাবে বপন করতে হয়, কীভাবে ছাঁটাই করতে হয়, কোন মৌসুমে কোন জাত ভালো জন্মে, কীভাবে কম পানি ব্যবহারেও ভালো ফুল ফোটানো যায়, কীভাবে সূর্যের আলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কোন রোগের সময় কোন প্রতিকার, পরিবেশবান্ধব এসব শেখে। এটি কোনো আলাদা কোর্স নয়। বরং বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, পরিবেশবিদ্যা, গণিত সবকিছু একসঙ্গে বাস্তব চাষের মাঠে শেখানো হয়। একে বলা হয় Field-Integrated Learning অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষ চলে মাঠে, প্রকৃতির মাঝে।
ইকুয়েডরের অন্যতম বড় সাফল্য হলো water-efficient rose farming। শিক্ষার্থীরা দেখে ড্রিপ ইরিগেশন, সেন্সর-ভিত্তিক পানি মাপার প্রযুক্তি, মাটির আর্দ্রতা পড়ার যন্ত্র, পানি পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থাপনা, কীভাবে খামারে কাজ করে। একটি সাধারণ স্কুলছাত্র যখন দেখে, কোনো একটি ফার্ম আগের তুলনায় ৪০–৫০% কম পানি ব্যবহার করেও একই পরিমাণ ফুল উৎপাদন করছে, তখন তার কাছে টেকসই কৃষির ধারণা বইয়ের সংজ্ঞা না হয়ে বাস্তব সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
ইকুয়েডরের গোলাপচাষ বহু বছর ধরে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে মাটির গুণগত মান হারাচ্ছিল। Sustainable Rose Education-এ শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় কম্পোস্ট ব্যবহার, জৈব সার তৈরি, ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা, মাটির পিএইচ ব্যালান্স, জৈব কার্বন ধরে রাখা, বায়োফার্টিলাইজার তৈরি। এসব স্কুল–স্তরের শিক্ষায় যুক্ত হওয়া শুধু ইকুয়েডরেই নয়, বিশ্বজুড়ে বিরল একটি উদাহরণ। শিক্ষার্থীরা যখন নিজেরাই দেখে স্বাস্থ্যবান মাটি মানে সুস্থ ফুল, আর সুস্থ ফুল মানে টেকসই উৎপাদন, তখন তারা প্রকৃতির সঙ্গে কাজ করার মানে আসলে কী তা সত্যিই বুঝতে পারে।
চাষাবাদে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে পরিবেশ, জলাশয় এবং কর্মীদের স্বাস্থ্যে ক্ষতি হতো। এখন ফার্মগুলোতে বায়োলজিক্যাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই শেখানো হয়। যেমন: উপকারী পোকা ব্যবহার, প্রাকৃতিক ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়া, জৈব হরমোন, উদ্ভিদ–ভিত্তিক “নন–টক্সিক” প্রতিকার। শিক্ষার্থীরা শেখে কীভাবে প্রকৃতি নিজেই তার সমস্যার সমাধান করে। এই শিক্ষা ভবিষ্যতের কৃষিকে রসায়নভিত্তিক নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে বড় ভূমিকা রাখছে।
ফার্মে প্রবেশ করার সাথে সাথে শিক্ষার্থীরা অনুভব করে হাজারো ফুলের সারি, সুগন্ধে ভরা হালকা বাতাস, সবুজ টানেলের নিচে ছায়া, কাঁচের ঘরে নিয়ন্ত্রিত আলো, টানেল–ভিত্তিক স্মার্ট সেচ। এই পরিবেশই যেন জীবন্ত শ্রেণিকক্ষ। শিক্ষকরা শুধু গাইড।
মূল শিক্ষক তো প্রকৃতি নিজেই।
ইকুয়েডরের এই মডেল বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবচিত্রও শেখায়। শিক্ষার্থীরা মাঠেই দেখে-
তাপমাত্রা বাড়লে ফুলের আকৃতি কীভাবে বদলে যায়! খরা এলে কীভাবে উৎপাদন কমে। অতিরিক্ত বৃষ্টি এলে কীভাবে রোগ বাড়ে। বৃষ্টির পানি কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়। এভাবে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের কাছে আর জটিল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে- শিক্ষার্থীরা যখন এই শিক্ষা গ্রহণ করে, তখন তারা বাড়িতে গিয়ে-
⇨ বাবা–মায়ের ক্ষেতে ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবহারের পরামর্শ দেয়
⇨ রাসায়নিক কমাতে পরামর্শ দেয়
⇨ কম্পোস্ট তৈরিতে সাহায্য করে
⇨ পানি অপচয় দেখলে সচেতন করে
এভাবে স্কুলের শিক্ষা পরিবারের জীবনযাপনে বদল আনে।
ইকুয়েডরের Sustainable Rose Education শুধু গোলাপচাষ শেখানোর একটি প্রোগ্রাম নয়। এটি পরিবেশ, প্রযুক্তি, সমাজ ও ভবিষ্যত উন্নয়নের এক অনন্য শিক্ষাদর্শন। এটি দেখিয়েছে, প্রকৃতি–নির্ভর শিক্ষা প্রজন্মকে বদলে দিতে পারে। একটি ফুলের খামারও হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্রেণিকক্ষ। ইকুয়েডরের শিশুরা আজ গোলাপের ঘ্রাণের মধ্যে যে শিক্ষা নিচ্ছে, তা একদিন দেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তুলবে। এ কারণেই অনেকেই বলছেন, “ইকুয়েডরে গোলাপ এখন শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়; এটি ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।”
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।