স্মার্ট প্রোস্থেটিকস নিয়ে সারা বিশ্বে ঝড়! জানুন এই নতুন প্রযুক্তির রহস্য
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানব সভ্যতার প্রযুক্তিগত যেসব অগ্রগতি মানবদেহের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে, স্মার্ট প্রোস্থেটিক্স তার মধ্যে সবচেয়ে বিপ্লবী। একসময় কৃত্রিম অঙ্গ বলতে বোঝাত কাঠের পা, সাধারণ লৌহ হাত বা স্থির প্লাস্টিকের কোনো উপকরণ,যার ভূমিকা ছিল কেবল ভরসা দেওয়া, হাঁটার সুবিধা করে দেওয়া বা দৈনন্দিন কিছু কাজ করতে সাহায্য করা। কিন্তু বিগত দুই দশকে প্রযুক্তির এমন অগ্রগতি হয়েছে যে কৃত্রিম অঙ্গ এখন শুধু নাট-বল্টুর যান্ত্রিক যন্ত্র নয়; এর সাথে যুক্ত হয়েছে সেন্সর, সিগন্যাল ব্যাখ্যা করার অ্যালগরিদম, স্মার্ট ম্যাটেরিয়াল, কৃত্রিম পেশি, নিউরাল ইন্টারফেস এবং ডেটা লার্নিংয়ের ক্ষমতা। আজ স্মার্ট প্রোস্থেটিক্স এমন এক উন্নত ইকোসিস্টেমে পরিণত হয়েছে, যেখানে মানবদেহের স্নায়ু এবং যন্ত্র একসঙ্গে কাজ করে। মানুষের চিন্তা, মাংসপেশির কম্পন, বা স্নায়বিক সংকেত। সবই ডিজিটাল মেশিনের ভাষায় অনুবাদ হয়ে অঙ্গকে নড়াচড়া করায়। এই প্রযুক্তি শুধু চলাচল ফিরিয়ে দেয় না বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক অঙ্গের সীমাও ছাড়িয়ে যায়। এর ফলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর জীবনের সীমা নয় বরং প্রযুক্তি হয়ে উঠছে ক্ষমতার নতুন দরজা।
কৃত্রিম অঙ্গের ইতিহাস দীর্ঘ। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় কাঠ বা হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি কৃত্রিম পায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। মধ্যযুগ, রেনেসাঁ ও আধুনিক শিল্পযুগে এই প্রযুক্তি যান্ত্রিকতার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটি অঙ্গের জায়গায় আরেকটি অঙ্গের মতো দেখতে কিছু বসিয়ে দেওয়া, যা দৈনন্দিন চলাচল ও ভারসাম্যের কিছুটা জোগান দেবে।স্মার্ট প্রোস্থেটিক্স এই ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। এগুলো শুধু অঙ্গের মতো দেখতে নয়, বরং মানুষের দেহগত সংকেত বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে। এদের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে-
⇨ নিউরাল সিগন্যাল রিডিং (মানুষের স্নায়ুর ইলেকট্রিক সংকেত পড়া)
⇨ ইলেকট্রনিক সেন্সর (চাপ, গতি, অবস্থান, বল শনাক্ত করা)
⇨ মোটর–চালিত সুনির্দিষ্ট নড়াচড়া
⇨ এআই–ভিত্তিক শেখার ক্ষমতা (ব্যবহারকারীর অভ্যাস অনুযায়ী পরিবর্তন)
⇨ ফিডব্যাক সিস্টেম (ব্যবহারকারী অনুভব করতে পারে- কোথায় চাপ পড়ছে, কীভাবে অঙ্গ নড়ছে)
একসময় যা অসম্ভব মনে হতো, যেমন: স্পর্শের অনুভূতি ফিরিয়ে দেওয়া, সূক্ষ্ম কাজ করার ক্ষমতা, কিংবা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় স্বয়ংক্রিয় ভারসাম্য এগুলো এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে বাস্তবতা।
স্মার্ট প্রোস্থেটিক্সের কার্যপদ্ধতি তিনটি স্তরে বিভক্ত:
(ক) সেন্সর লেয়ার, দেহ থেকে সংকেত সংগ্রহ: স্মার্ট প্রোস্থেটিক্সে বহু সেন্সর থাকে। এগুলো দেহের মাংসপেশির সূক্ষ্ম কম্পন, স্নায়ুর ক্ষীণ বৈদ্যুতিক সিগন্যাল, শরীরের চাপ, গতি, রোটেশন ও তাপমাত্রা তথ্য সংগ্রহ করে। এই সংকেতগুলো সাধারণত EMG (Electromyography) সেন্সরের মাধ্যমে ধরা হয়। কেউ হাত নড়ানোর কথা ভাবলে মাংসপেশিতে ক্ষুদ্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি হয়। সেই তরঙ্গকেই সেন্সর ধরে।
(খ) প্রসেসিং ইউনিট, সংকেত বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত: সেন্সর তথ্য সংগ্রহ করার পর সেগুলো একটি ছোট কম্পিউটারের মতো ইউনিটে যায়, যাকে Control Processor বলে। এটি সংকেতের অর্থ বোঝে, ব্যবহারকারীর প্রতিটি অভ্যাস শিখে, মেশিন লার্নিং মডেলের মাধ্যমে পরবর্তী নড়াচড়া অনুমান করে মোটরকে নির্দেশ দেয় কীভাবে নড়তে হবে। এই পর্যায়ে অ্যালগরিদমের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
(গ) মেকানিক্যাল এক্সিকিউশন, বাস্তবে নড়াচড়া সৃষ্টি: অবশেষে নির্দেশ যায় মোটর, কৃত্রিম জোড়, কৃত্রিম পেশি ও স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালে। ফলে কৃত্রিম অঙ্গ বাঁকতে পারে, ঘুরতে পারে, শক্তি প্রয়োগ করতে পারে, সূক্ষ্ম কাজ করতে পারে। এই পুরো প্রক্রিয়া ঘটে মিলিসেকেন্ডে। তাই ব্যবহারকারী প্রায় প্রাকৃতিক অঙ্গের মতোই নিয়ন্ত্রণ অনুভব করেন।
স্মার্ট প্রোস্থেটিক্সের সবচেয়ে উন্নত স্তর হলো নিউরাল ইন্টারফেস প্রযুক্তি, যেখানে মস্তিষ্কের স্নায়ু জালের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা হয়।
নিউরাল ইন্টারফেস কী করে?
মস্তিষ্ক যে অংশ দিয়ে হাত নড়ানোর আদেশ দেয়, সেই সংকেত সরাসরি প্রোস্থেটিক্সে প্রেরণ করে।
ফলে ব্যবহারকারী ভাবলেই অঙ্গ নড়ে। কোনো বাটন বা পেশি চাপ দিতে হয় না। এ প্রযুক্তি এখনো উন্নয়নশীল হলেও এমন উদাহরণ রয়েছে যেখানে ব্যবহারকারী কৃত্রিম হাতে আবারো লিখতে, টাইপ করতে বা সূক্ষ্ম জিনিস নিয়ে কাজ করতে পেরেছেন। নিউরাল ইন্টারফেস ভবিষ্যতে স্মার্ট প্রোস্থেটিক্সকে দেহের অংশের চেয়েও বেশি উন্নত করে তুলবে।
স্মার্ট প্রোস্থেটিক্সের তিন বড় সুবিধা:
১) মানুষের জীবনমান সম্পূর্ণ বদলে দেয়। প্রতিদিনের কাজ- হাঁটা, দৌড়ানো, রান্না করা, টাইপ–সেলাই সবই আবারো করা সম্ভব হয়।
২) মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শারীরিক সীমাবদ্ধতা অনেক সময় আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেয়। স্মার্ট অঙ্গ প্রযুক্তি মানুষকে তার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়।
৩) কর্মক্ষেত্রেও ফিরে যাওয়া সহজ হয়। ব্যক্তি আবার পূর্বের মতো কাজ করতে পারেন। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও এটি বড় ভূমিকা রাখে।
স্মার্ট প্রোস্থেটিক্সে যে প্রযুক্তি যুক্ত হয়:
◑ Artificial Muscles (কৃত্রিম পেশি)-তরল, বায়ু বা বৈদ্যুতিক সংকেতে সংকুচিত হয়।
◑ Microprocessors-ব্যবহারকারীর গতি অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত নেয়।
◑ Carbon fiber & lightweight alloys-অঙ্গকে হালকা ও শক্তিশালী করে।
◑ AI Motion Prediction-ব্যবহারকারীর অভ্যাস শিখে পরবর্তী পদক্ষেপ অনুমান।
◑ Smart Grips-ধরা জিনিস শক্ত হলে শক্ত গ্রিপ, ভঙ্গুর হলে নরম গ্রিপ।
যন্ত্র, অ্যালগরিদম ও মানুষের দেহ এই তিনের সমন্বয় তৈরি করে নতুন ধরনের বায়োমেকানিক্স।
বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে যেসব উন্নয়নকে কেন্দ্র করে কাজ করছেন:
১) কৃত্রিম স্পর্শ অনুভূতি: ব্যবহারকারী যে জিনিস ধরছেন তার উষ্ণতা, চাপ ও টেক্সচার অনুভব করতে পারবেন।
২) স্বয়ংক্রিয় স্ব-পরিবর্তনশীল অঙ্গ: অঙ্গ নিজেই বুঝবে ব্যবহারকারীর হাঁটার গতি, জুতার ধরন, রাস্তার ঢাল এবং সে অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নেবে।
৩) মস্তিষ্কের স্মৃতি ব্যবহারের সক্ষমতা: নিউরাল প্যাটার্ন স্টোর হয়ে পুনরায় ব্যবহার হবে। ব্যবহারকারী একবার শিখলেই হবে, অঙ্গ তা মনে রাখবে।
৪) কৃত্রিম ত্বক:নরম, নমনীয়, সেন্সরযুক্ত ত্বক যা বাহ্যিক চাপ, ঘর্ষণ বা তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করতে পারবে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে স্মার্ট প্রোস্থেটিক্স ব্যবহারকারীরা শুধু দৈনন্দিন কাজে ফিরেই আসেন না বরং নতুন কিছু করতে সক্ষম হন। যেমন-
কেউ আবার খেলাধুলায় ফিরে আসছেন, কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারছেন, কেউ দশ আঙুলের সূক্ষ্ম কাজও করছেন, অনেকে আগের চেয়ে দ্রুত হাঁটছেন। এটি মানবদেহ ও প্রযুক্তির সমন্বয়কে নতুন দিক থেকে ব্যাখ্যা করে।
মানবদেহের বিকল্প অঙ্গ তৈরির গল্প এখন আর কৃত্রিম পায়ের গল্প নয়। এটি হচ্ছে মানবসত্তাকে নতুন স্বাধীনতা দেওয়ার গল্প। স্মার্ট প্রোস্থেটিক্স শুধুই যান্ত্রিক উন্নতি নয়, এটি মানব জীবনের গভীর মানবিকতার প্রযুক্তিগত পুনর্গঠন। মানবদেহের সীমা যেখানে শেষ, প্রযুক্তি সেখানে হাত বাড়াচ্ছে।
মানুষ আর মেশিনের এই সহাবস্থান আমাদের শেখাচ্ছে- কম্পিউটার মানবদেহকে প্রভাবিত করছে না; বরং মানুষ তার হারানো সম্ভাবনাকে নতুন আকারে ফিরে পাচ্ছে। স্মার্ট প্রোস্থেটিক্স তাই শুধু ভবিষ্যৎ নয়, এ বর্তমান বিশ্বের মানবসক্ষমতার নতুন প্রতিচ্ছবি।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।