কোকোপিট: গাছের শিকড়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন,শহুরে বাগানকে সহজ করে দিচ্ছে নারিকেলের আঁশ!

কোকোপিট: গাছের শিকড়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন,শহুরে বাগানকে সহজ করে দিচ্ছে নারিকেলের আঁশ!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

শহরের ব্যস্ততা, কংক্রিটের ভিড়, ধুলো–দূষণ আর সীমিত খোলা জায়গার ভেতরেও মানুষ এখন একটু সবুজ, একটু প্রাণ, একটু অক্সিজেনের খোঁজে বাগান করতে আগ্রহী হচ্ছে আগের চেয়ে বহু গুণ বেশি। কিন্তু সমস্যা একটাই, তা হলো -ভাল মাটি পাওয়া আজ শহরে বিলাসিতা। মাটিতে জীবাণু থাকে, পোকা থাকে, কখনো কঠিন, কখনো কাদায় ভরা, আবার কখনো পুষ্টিহীন। এর সঙ্গে যোগ হয় অনিয়মিত পানি দেওয়া, রোদ না পাওয়া, শিকড় পচে যাওয়া, যা নিয়ে নতুন বাগানিদের প্রায়ই হতাশ হতে হয়। এই হতাশার মাঝেই এক নীরব হিরো শহুরে বাগানের জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কোকোপিট, যা আসলে শুকনো নারিকেলের খোলের তন্তু থেকে তৈরি। যা আগে ছিল নারিকেল শিল্পের অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য, সেটাই আজ পৃথিবীজুড়ে উদ্ভিদ চাষে সবচেয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হওয়া গ্রোথ মিডিয়া।

কোকোপিট আসলে কী?

নারিকেলের বাইরের যে শক্ত আঁশ আমরা দেখি, তা আসলে ফাইবারে সমৃদ্ধ। সেই আঁশ শুকিয়ে, পিষে, ছেঁকে, জীবাণুমুক্ত করে কোকোপিট তৈরি করা হয়।
এতে থাকে-

☞ লিগনিন, যা কোকোপিটকে টেকসই, ফাঙ্গাস-প্রতিরোধী এবং পানির নিচে স্থিতিশীল রাখে।

☞ সেলুলোজ, পানি ধরে রাখে, শিকড়কে আর্দ্রতা জোগায়।

☞ এয়ার পোরস, শিকড়ের জন্য নিখুঁত বাতাস চলাচল তৈরি করে।

যেখানে মাটির কণা শক্ত হয়, সেখানে কোকোপিট স্পঞ্জের মতো নরম এবং বাতাস-পারগম্য। যার অর্থ শিকড় গর্তের মতো পরিবেশ পায়, আরাম পায় এবং দ্রুত বাড়ে।

 

কেন কোকোপিট আজ শহুরে বাগানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান?

নিচের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য কোকোপিটকে মাটিকে ছাড়িয়ে আলাদা শ্রেণিতে নিয়ে গেছে-

১. পানি ধরে রাখার ক্ষমতা প্রায় অবিশ্বাস্য।

কোকোপিট নিজের ওজনের ৮ থেকে ১০ গুণ পানি ধরে রাখতে পারে। অর্থাৎ আপনি সকালে পানি দিলেন, আর সন্ধ্যায়ও শিকড়ে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা থাকে। যারা ব্যস্ত, অফিস করেন, প্রতিদিন পানি দিতে পারেন না, তাদের জন্য এটি এক অসাধারণ সমাধান। মাটিতে পানি হয় দ্রুত শুকিয়ে যায়, না হলে জমে যায়। কিন্তু কোকোপিট স্পঞ্জের মতো হওয়ায় যতটা দরকার ধরে রাখে, অতিরিক্তটা বের করে দেয়। এটাই গাছের জীবনের সবচেয়ে নিরাপদ সমীকরণ।

 

২. শিকড়ের জন্য 'শ্বাস নেওয়ার' পরিবেশ।

উদ্ভিদ গবেষণায় বলা হয়, শিকড় যদি সুস্থ থাকে, গাছ শতভাগ সুস্থ থাকবে। মাটির টেক্সচার ঘন হয়ে গেলে শিকড় শ্বাস নিতে পারে না। কিন্তু কোকোপিটের কণাগুলো বাতাস চলাচলের জন্য আলাদা আলাদা ফাঁক তৈরি করে। ফলে শিকড় বেশি ছড়ায়, কম পচে ,অক্সিজেন বেশি পায়, পুষ্টিগুলো ভালোভাবে শোষণ করে, গাছ দ্রুত বাড়ে, গাছের জন্য এ যেন এক ফাইভ-স্টার গ্রোথ এনভায়রনমেন্ট।

 

৩. রোগ জীবাণুর ঝুঁকি কম, গাছের জন্য নিরাপদ। মাটির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো  জীবাণু, ফাঙ্গাস, পেস্ট। কোকোপিট সাধারণত স্টেরাইল, মানে— ক্ষতিকর জীবাণু, ঘাস-গাছে জন্মানো বীজ
 

মাটির কীড়া, এসব প্রায় থাকে না। চারা গজানোর সময় বিশেষভাবে এটি উপকারী। কোমল গাছের চারা এমনিতেই সংবেদনশীল; কোকোপিট তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে।
 

৪. pH প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য। কোকোপিটের pH থাকে ৫.৫–৬.৮, যা প্রায় সব গাছের জন্য উপযুক্ত। একে বিজ্ঞানীরা সবজি, ফুল ও ইনডোর প্ল্যান্টের জন্য টপ-রেঞ্জ অ্যাসিডিটি বলে থাকেন। মাটিতে pH অতিরিক্ত অ্যাসিডিক বা ক্ষারীয় হলে গাছের গায়ে দাগ পড়ে, পাতা কুঁকড়ে যায়। কোকোপিট সেই সমস্যাগুলোকে প্রায় শূন্যে নিয়ে আসে।
 

৫. পরিবেশবান্ধব, ১০০% বায়োডিগ্রেডেবল।

কোকোপিট হলো রাসায়নিকমুক্ত, পুনর্ব্যবহারযোগ্য, পরিবেশে মিশে যায়, প্লাস্টিকবিহীন, মাটির চাপ কমায়। শহুরে বাগানে পরিবেশবান্ধবতার এই দিকটি আজ অত্যন্ত মূল্যবান।

 

কোন ক্ষেত্রে কোকোপিট সবচেয়ে সফল?

১. চারাগাছ তৈরিতে। চারা যেন নরম বিছানায় শুয়ে আছে, এমন পরিবেশ দেয় কোকোপিট। ফলে অঙ্কুরোদগম দ্রুত হয়, চারা লম্বা হয় না (লেগি হয় না), শিকড় গভীরে পৌঁছায়, ট্রান্সপ্লান্ট করলে মারা যায় না, বাণিজ্যিক নার্সারিগুলোও এই কারণেই চারার জন্য কোকোপিট ব্যবহার করে।

২. ইনডোর প্ল্যান্টের জন্য স্বপ্নের মাধ্যম। মানিপ্ল্যান্ট, স্পাইডার প্ল্যান্ট, পিস লিলি, মনস্টেরা—এসব গাছের শিকড় আর্দ্রতা পছন্দ করে।কিন্তু অতিরিক্ত পানি মোটেও সহ্য করতে পারে না।কোকোপিট উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে।ইনডোর রুমে আর্দ্রতা কম থাকে, আবার মাটিতে পানি দিলে পচে যেতে পারে।কোকোপিট এই সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধান।

৩. হাইড্রোপোনিক চাষ। হাইড্রোপনিক্সে মাটি নেই, উদ্ভিদ বড় হয় পানি ও পুষ্টির মিশ্রণে। কিন্তু শিকড়কে তো কোনো মাধ্যম ধরিয়ে রাখতে হয়! সেখানেই কোকোপিট হালকা, আর্দ্রতা ধরে, গ্রোথ মিডিয়া হিসেবে কাজ করে। বিশ্বব্যাপী হাইড্রোপনিক গার্ডেনে কোকোপিট এখন মানসম্মত উপাদান।

৪. ছাদবাগান ও হালকা ওজনের বাগান! মাটি ভারী, কিন্তু কোকোপিট অত্যন্ত হালকা। ছাদবাগানে যেখানে ওজন বড় বাধা, সেখানে কোকোপিট নিরাপদ। এটি গাছের ওজন কমিয়ে দেয়, ছাদকে চাপমুক্ত রাখে

 

কোকোপিট কীভাবে ব্যবহার করবেন-সঠিক পদ্ধতি

☞ কোকোপিট ভিজিয়ে নেওয়া। ব্লক অবস্থায় কোকোপিট খুব শক্ত থাকে। এক বালতি পানিতে রেখে দিলেই ফুলে নরম হয়ে যায়।
একটি ছোট ব্লকে প্রায় ২২–২৫ লিটার নরম কোকোপিট পাওয়া যায়।

 

☞ প্রয়োজনে ধুয়ে লবণ কমানো। কোকোপিট প্রথম অবস্থায় সামান্য প্রাকৃতিক লবণ থাকতে পারে। যদি লবণ মাত্রা বেশি হয় হালকা পানিতে ধুয়ে, রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করাই ভালো।
 

☞ সেরা মিশ্রণ তৈরি! সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত মিশ্রণ-

◑ ৫০% কোকোপিট

◑ ২৫% পার্লাইট (অক্সিজেন বাড়ায়)

◑ ২৫% কম্পোস্ট/ভার্মিকম্পোস্ট (পুষ্টি দেয়)
 

এ মিশ্রণ ফুল–সবজি–ইনডোর সব গাছেই উপযোগী।

☞  নিয়মিত পুষ্টি যোগ করা।কোকোপিট নিজে কোনো পুষ্টি দেয় না। তাই তরল সার, জৈব সার, ভার্মিকম্পোস্ট, ক্যালসিয়াম–ম্যাগনেসিয়াম মাসে অন্তত ২ বার ব্যবহার করতে হবে।
 

কোকোপিটের সীমাবদ্ধতা:

১. পুষ্টিহীন: মাটির মতো পুষ্টি নেই। এটি কেবল শিকড় ধরে রাখে, কিন্তু খাওয়ায় না। তাই সার ছাড়া গাছ দুর্বল হবে।

২. অনেক দিন ব্যবহার করলে ঘন হয়ে যায়: এক বছর পরে কোকোপিটের ফাইবার পচে গিয়ে ঘন হতে পারে। এ অবস্থায় শিকড় শ্বাস নিতে পারে না। এক্ষেত্রে  পুরোনো কোকোপিট খুলে শুকিয়ে আবার আলগা করতে হবে।

৩. অতিরিক্ত পানি দিলে সমস্যাও হতে পারে। যদিও পানি ধরে রাখার ক্ষমতা আছে, কিন্তু ড্রেনেজ ঠিক না হলে, টবের নিচে ছিদ্র না থাকলে গাছ পচে যেতে পারে।

 

কেন কোকোপিট ভবিষ্যতের বাগানচর্চায় সবচেয়ে বড় শক্তি?

বিশ্বজুড়ে এখন চলছে পরিবেশবান্ধব চাষ, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা, পানি সংরক্ষণ, ইনডোর গ্রিন স্পেস তৈরি- এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোকোপিট অদ্ভুতভাবে মানিয়ে যায়। কারণ কম পানি লাগে, মাটির ওপর চাপ কমায়, গাছ দ্রুত বাড়ায়, হাইড্রোপনিক্সে উপযোগী, কেমিক্যালমুক্ত। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে,শহুরে কৃষির ভবিষ্যতে কোকোপিট অপরিহার্য হয়ে উঠবে।

হাজার ব্যস্ততার মাঝেও শহরের মানুষ গাছের কাছে ফিরে যেতে চাইছে।এক টব তুলসী, এক মানিপ্ল্যান্ট, এক রোজ প্ল্যান্ট  ঘরে শান্তি এনে দেয়। কিন্তু গাছ বাঁচানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জকে সহজ করেছে কোকোপিট। নারিকেলের আঁশ থেকে জন্ম নেওয়া এই মাধ্যম আজ বিজ্ঞানসম্মত, সহজ, পরিচ্ছন্ন, হালকা, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান। কোকোপিট গাছকে শুধু বড় হতে সাহায্য করে না, গাছ বাঁচিয়ে রাখার নিশ্চয়তা দেয়।
এটাই এর আসল শক্তি। শহুরে বাগানের জগতে কোকোপিট তাই আর শুধু একটি উপাদান নয়, এটি এক নতুন যুগের সূচনা।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ