জুঁই ফুল কি মানুষের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে?-ঘ্রাণ-বিজ্ঞানে উঠে এলো চমকে দেওয়া তথ্য !

জুঁই ফুল কি মানুষের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করে?-ঘ্রাণ-বিজ্ঞানে উঠে এলো চমকে দেওয়া তথ্য !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

রাত ঘনিয়ে আসছে। শহরের গাড়ির শব্দ দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কেউ হয়তো জানালার পাশে রাখা ছোট এক টব থেকে ভেসে আসা জুঁই ফুলের ঘ্রাণে হঠাৎই অনুভব করছেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি। চোখ যেন স্বাভাবিকভাবে ভারী হয়ে আসে, মনের ভেতর জমে থাকা উদ্বেগ আস্তে আস্তে নরম হয়ে ভেঙে পড়ে। কিন্তু প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে, জুঁই ফুলের ঘ্রাণ এমন শান্তি সৃষ্টি করে কেন? এটা কি কেবল সাংস্কৃতিক অনুভূতি? নাকি আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে ঘ্রাণের সঙ্গে বাঁধা পড়ে থাকা কোনো জৈব-রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া?

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন-জুঁইয়ের সুবাস আমাদের শরীর–মনকে প্রভাবিত করে খুব নির্দিষ্ট, অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক কিছু কারণে। আর সেই কারণগুলোই ধীরে ধীরে উন্মোচন করছে ঘ্রাণ-মনোবিজ্ঞানের এক চমকপ্রদ অধ্যায়।
 

ঘ্রাণ বা 'অলফ্যাকশন' মানুষের সংবেদনশীলতার অন্যতম গভীর এবং শক্তিশালী উপায়। চোখ বা কানের মতো দূরত্বের ওপর নির্ভর না করে, ঘ্রাণ সরাসরি মস্তিষ্কের সেই অংশে পৌঁছে যায়, যেটি আবেগ, স্মৃতি এবং স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করে। এর জন্য দায়ী একটি বিশেষ স্নায়ুবৈজ্ঞানিক পথ, যাকে বলা হয় Olfactory-Limbic Connection। যখন আমরা জুঁই ফুলের সুবাস নিই, নাকের ভেতরের রিসেপ্টরগুলো সেই রাসায়নিক কণাকে শনাক্ত করে। কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে সিগন্যাল পৌঁছে যায় লিম্বিক সিস্টেমে, বিশেষ করে অ্যামিগডালা (ভয়, স্ট্রেস, আবেগ নিয়ন্ত্রণ), হিপোক্যাম্পাস (স্মৃতি ও মানসিক স্থিতি), হাইপোথ্যালামাস (হরমোন নিয়ন্ত্রণ)। এগুলো মিলেই তৈরি করে 'ইমোশনাল রেসপন্স'। জুঁই ফুলের ঘ্রাণ এই লিম্বিক সিস্টেমে একধরনের প্রশান্ত সংকেত পাঠায়, যা উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে।


 

মনোবিজ্ঞানী ও ঘ্রাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, জুঁই ফুলের ঘ্রাণে থাকে এমন কিছু ভোলাটাইল অ্যারোমেটিক কম্পাউন্ড, যেগুলো আমাদের মস্তিষ্কে স্বাভাবিকভাবেই 'শান্তি সৃষ্টিকারী' প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো:

১) Benzyl Acetate- এই উপাদানটির সুবাস মস্তিষ্কে অ্যামিগডালার উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে। অ্যামিগডালা শান্ত হলে শরীরের স্ট্রেস-রিসপন্সও কমতে শুরু করে।

২) Linalool-এর মতো নরম, হালকা সেডেটিভ বৈশিষ্ট্য- কিছু জুঁই প্রজাতির ঘ্রাণে স্বাভাবিকভাবে উপস্থিত লিনালুল নামের যৌগ 'নরম স্নায়ু শিথিলকারী' হিসেবে কাজ করে।

৩) GABAergic কার্যকারিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা!

মনোবিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণে দেখেছেন, কিছু সুগন্ধি মস্তিষ্কে GABA (গামা অ্যামিনো বিউট্রিক অ্যাসিড) নামের নিদ্রা ও শান্তির জন্য দায়ী নিউরোট্রান্সমিটারকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে। জুঁই ফুলের ঘ্রাণও এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় সহায় হতে পারে। ফলে উদ্বেগ কমে, হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক হয় মন স্থির থাকে, ঘুমের প্রবণতা বাড়ে। 

এই প্রক্রিয়াটি এমনভাবে কাজ করে যেন কেউ স্বাভাবিকভাবে গভীর শ্বাস নিয়ে শরীরকে শিথিল করছে।
 

মনোবিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে 'Affective Olfaction' নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের পর্যবেক্ষণগুলো জুঁই ফুলের ঘ্রাণের প্রভাব নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেয়:

১) ঘ্রাণ সরাসরি স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত আর স্মৃতি নিয়ন্ত্রণ করে আবেগকে! মানুষের অনেক ইতিবাচক স্মৃতি থাকে ঘ্রাণ-সম্পর্কিত। জুঁই ফুল দক্ষিণ এশিয়া, আরব অঞ্চল ও পূর্ব এশিয়ার বহু ঘরোয়া সংস্কৃতির অংশ।ফলে এর ঘ্রাণে শৈশবের স্মৃতি, উৎসবের আবহ, বাগানের সন্ধ্যা, প্রিয় মানুষের উপস্থিতি অবচেতনভাবে ভেসে ওঠে এবং মনকে শান্ত করে।

 

২) ঘ্রাণ স্ট্রেস হরমোন কমাতে সাহায্য করে।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ইতিবাচক সুবাস মানবদেহে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা কমাতে পারে। জুঁই ফুল সেই তালিকায় অন্যতম। ফলে শরীরের টেনশন, মানসিক অস্থিরতা কমে যায়।

 

৩) জুঁই ফুলের ঘ্রাণ সামাজিক সিগন্যালিং প্রভাব ফেলে। অনেক গবেষণা-আলোচনায় দেখা গেছে- মিষ্টি, নরম ও গভীর সুবাস মানুষের আচরণে কোমলতা আনতে সাহায্য করতে পারে। এটি 'সোশ্যাল ক্যাল্মিং ইফেক্ট' নামে পরিচিত। জুঁইয়ের সুবাস সেই কোমলতার অনুভূতি তৈরি করে। মানুষ অবচেতনভাবে পরিবেশ নিরাপদ, চাপ কম, মস্তিষ্ক বিশ্রামে যেতে পারে- অনুভব করে। এই নিরাপত্তা অনুভূতির কারণেই জুঁই ফুলের ঘ্রাণকে মনোবিজ্ঞানীরা 'প্রাকৃতিক স্নায়ু-শান্তিকারী' হিসেবে দেখেন।
 

ঘ্রাণ-ভিত্তিক থেরাপি বা Aromatic Wellness বিশ্বজুড়ে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। এর একটি কারণ হলো ঘ্রাণের প্রভাব দ্রুত ও নিরাপদ। জুঁই ফুল সেখানে সামনে আসছে তিনটি কারণে-

১) শারীরিক ক্লান্তি কমাতে সহায়ক। জুঁইয়ের ঘ্রাণ স্নায়ুতন্ত্রে শিথিলতার সংকেত পাঠায়, যার ফলে শরীর ধীরে ধীরে রিল্যাক্স মোডে চলে যায়।

২) মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। অনেকেই ভাবেন শান্তি মানে ঘুম, কিন্তু সব সময় তা নয়। অল্পমাত্রায় জুঁইয়ের সুবাস মনকে পরিষ্কার করতে এবং মনোসংযোগ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

৩) উদ্বেগ ও মানসিক অস্থিরতা কমাতে কার্যকর। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নিয়মিত হালকা জুঁই সুবাস—দীর্ঘদিন ধরে থাকা উদ্বেগ কাজের মানসিক চাপ, ঘরের ভেতর ক্লান্তিকর পরিবেশ, বিশেষ করে কাজের সময় বা ঘুমানোর আগে ব্যবহৃত হলে মানসিক ভার কমাতে সাহায্য করতে পারে।
 

জুঁই ফুলের সুবাস অন্য অনেক ফুলের চেয়ে বেশি কার্যকর মনে হয়।এর কারণ লুকিয়ে রয়েছে এর "ঘ্রাণ-প্রোফাইল"-এ। জুঁই ফুলের গন্ধ কোমল, গভীর, অল্প-মিষ্টি, দীর্ঘস্থায়ী এবং খুব সূক্ষ্ম স্নায়বিক উত্তেজনা তৈরি করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাকে অন্য অনেক সুগন্ধির থেকে আলাদা করে। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের মতে, জুঁইয়ের সুবাসের অণুগুলো বাতাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও তারা তীব্র নয়, ফলে গন্ধটি মাথা ব্যথা বা বিরক্তি সৃষ্টি করে না। প্রকৃতি যেন জুঁই ফুলকে তৈরি করেছে 'শান্তির ঘ্রাণ' হিসেবে।
 

জুঁই ফুলের সুবাস নিলে স্ট্রেস রেসপন্স ধীর হতে থাকে।
অনেক মনোবিজ্ঞানী লক্ষ্য করেছেন, মানুষ যখন জুঁইয়ের মৃদু ঘ্রাণ নেয়, তখন-

⇨ শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে আসে

⇨ পালস স্বাভাবিক হয়

⇨ রক্তচাপ স্থির থাকে

⇨ পেশির টান কমে

এগুলো ঘটে Parasympathetic Nervous System সক্রিয় হওয়ার কারণে, যাকে বলা হয় 'Rest and Relax Response'। অর্থাৎ, জুঁই ফুলের সুবাস শরীরকে বলে— সব ঠিক আছে, এখন শান্ত হও।

 

জুঁই ফুলের স্থান শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানে বা মনোবিজ্ঞানে নয়। সংস্কৃতিতেও এর প্রভাব প্রবল।

⇨ দক্ষিণ এশিয়ায় উৎসব

⇨ আরব অঞ্চলে আতিথেয়তা

⇨ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধর্মীয় আচার

⇨ বাড়ির সাজ

⇨ চুলে জুঁই গাঁথার ঐতিহ্য

সব মিলিয়ে জুঁই ফুলের গন্ধ মানুষের মনে গভীর ইতিবাচক স্মৃতি তৈরি করেছে। এই স্মৃতির সুত্রেই জুঁই ফুলের ঘ্রাণ মানসিক প্রশান্তি জাগায় আরও শক্তিশালীভাবে।
 

জুঁই ফুলের উপস্থিতিই পরিবেশে নরম মানসিক প্রভাব ফেলে-

⇨ ঘরের আবহ কোমল করে

⇨ মুড স্থিতিশীল রাখে

⇨ মনকে ইতিবাচক দিকে ঘোরায়

⇨ চিন্তাকে ধীর ও পরিষ্কার করে

 

ঘ্রাণ ছাড়াও, এর সাদা রঙ ও কোমল পাপড়ি চোখে অনাবিল শান্তি আনে। দৃশ্য-সংবেদী শান্তির সঙ্গে ঘ্রাণ-সংবেদী প্রশান্তি একত্র হয়ে মনের ওপর আরও গভীর প্রভাব ফেলে।

জুঁই ফুলের সুবাস আমাদের শান্ত করে কারণ এটি সরাসরি মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে কাজ করে । চাপ কমাতে সাহায্য করা নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা বাড়ায়। স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইতিবাচক আবেগ উস্কে দেয়। শরীরের স্বাভাবিক শিথিল প্রতিক্রিয়া সক্রিয় করে। মানসিক স্বস্তি ও নিরাপত্তার অনুভূতি জাগায়। হয়তো তাই ব্যস্ত শহরের মাঝে এক গুচ্ছ জুঁই শুধু ফুল নয়, এ যেন এক বিনামূল্যের মানসিক থেরাপি। ঘর, কর্মস্থল, বাগান কিংবা রাত্রিকালীন হাঁটায় জুঁই ফুলের সুবাস আমাদের ভেতরের অস্থিরতাকে নরম করে ছুঁয়ে দেয়। আর সেই ছোঁয়াই আমাদের মনে এনে দেয় প্রশান্তির এক গভীর, মানবিক অনুভূতি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ