Reward না Punishment-কোনটা মানুষকে দ্রুত শিখায়? মনোবিজ্ঞানে মিলছে চমকানো ফলাফল!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের আচরণ কি জন্মগত, নাকি শেখা? আমরা কি জন্মগতভাবে ভদ্র, সহযোগিতাপ্রবণ, নিয়মমানা নাকি পরিবেশ আমাদের এসব শিখিয়ে দেয়? প্রতিদিনের জীবনচর্চায় যে ছোট ছোট সিদ্ধান্ত, প্রতিক্রিয়া ও অভ্যাস আমরা গড়ে তুলি তার পেছনে একটি গভীর মনোবৈজ্ঞানিক শক্তি কাজ করে। এই শক্তির নাম Operant Conditioning।
পুরস্কার এবং শাস্তির মাধ্যমে নতুন আচরণ শেখা।এই ধারণাটি শত বছর আগে মনোবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। আজও শিক্ষা, অভিভাবকত্ব, কর্মক্ষেত্র, প্রযুক্তি ডিজাইন, সামাজিক প্ল্যাটফর্ম, বিজ্ঞাপন সব জায়গায় এর নীরব প্রভাব দৃশ্যমান। আমরা হয়তো বুঝি না, কিন্তু আমাদের আচরণকে প্রতি মুহূর্তে কেউ না কেউ, কোনো না কোনো সিস্টেম পুরস্কার দিয়ে টেনে নিচ্ছে বা শাস্তি দিয়ে সরিয়ে রাখছে।
সহজ ভাষায়, যে আচরণে পুরস্কার মিলবে, সেই আচরণ ভবিষ্যতে বাড়বে। আর যে আচরণের পরে অপ্রীতিকর ফল মেলে, সেই আচরণ কমবে।
এই পুরস্কার শুধু টাকা বা বাহবা নয়। হতে পারে হাসি, প্রশংসা, স্বস্তি, ব্যথা কমে যাওয়া, ঝামেলা এড়ানো, সামাজিক মূল্য এমনকি নিজের ভেতরের শান্তির অনুভূতিও একটি পুরস্কার হিসেবে কাজ করে। একটি ছোট উদাহরণঃ
শিশু যখন প্রথম বার স্কুলে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নেয়, তখন মা যদি বলেন, "বাহ! খুব ভালো করেছ"। তখন শিশুর মনে উদ্দীপনা তৈরি হয়। পরদিন সে আবার ব্যাগ গুছাতে আগ্রহী হয়। এই আগ্রহই অপারেন্ট কন্ডিশনিংয়ের প্রথম ছাপ।
অপারেন্ট কন্ডিশনিং আচরণকে তিনটি ধাপে ব্যাখ্যা করে-
১) আচরণ (Behavior): একটি ব্যক্তি কী করছে-লেখা, বলা, সাহায্য করা, চিৎকার করা, শান্ত থাকা, কাজ ফেলে রাখা সবই 'আচরণ' বিভাগে পড়ে।
২) পরিণাম (Consequence): আচরণের পরে যে প্রতিক্রিয়া বা ফল আসে। সেটি হতে পারে সুখকর বা অসুখকর।
৩) ভবিষ্যৎ প্রভাব (Effect on future behavior): পরিণাম ভালো হলে আচরণ বাড়ে, খারাপ হলে কমে।এই তিন ধাপই আচরণ গঠনের 'অদৃশ্য চক্র' তৈরি করে।
পুরস্কার: আচরণ বাড়ানোর সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম-
১) Positive Reinforcement - কিছু পাওয়া যায় বলে আচরণ বাড়ে। এখানে আচরণের পরে ভালো কিছু পাওয়া যায়।
যেমন- কর্মী ভালো কাজ করলে বোনাস পাওয়া, শিশুকে পড়াশোনায় মনোযোগ দিলে অতিরিক্ত গল্প শোনানো, ব্যায়াম করলে শরীরে ভালো লাগা ইত্যাদি । এতে মস্তিষ্ক আনন্দের রাসায়নিক ডোপামিন নিঃসরণ করে। ফলে আচরণটি পুনরাবৃত্তি করার প্রবণতা বাড়ে।
২) Negative Reinforcement - অসুবিধা দূর হওয়ায় আচরণ বাড়ে! এখানে পুরস্কার হিসেবে কোনো অসুবিধা কমে যায়। যেমন—
গাড়ির সিটবেল্ট না পরলে বিপ-বিপ শব্দ হয়; বেল্ট পরলেই শব্দ বন্ধ- অসুবিধা দূর হওয়া এখানে পুরস্কার। মাথা ধরলে পানি খেয়ে ভালো লাগা। এটিও আচরণকে শক্তিশালী করে। অনেক সময় আমরা ভুল করে এটি 'শাস্তি' মনে করি, কিন্তু এটি আসলে পুরস্কারই, কারণ তা আচরণ বাড়ায়।
শাস্তি: আচরণ কমানোর মনোবৈজ্ঞানিক পথ-
১) Positive Punishment, অপ্রীতিকর কিছু যোগ হয়। যেমন-
⇨ ভুল করলে তিরস্কার
⇨ অসদাচরণে সামাজিক অপমান
⇨ নিয়ম ভাঙলে জরিমানা
এতে আচরণের পরে নেতিবাচক অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়।
২) Negative Punishment, ভালো কিছু হারিয়ে যায়- যেমন-
⇨ শিশুর স্ক্রিন টাইম বন্ধ
⇨ কর্মক্ষেত্রে সুবিধা বাতিল
⇨ কোন ক্লাবে যোগদানের অনুমতি স্থগিত
এগুলো আচরণ কমাতে পারে। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলছে, শাস্তি সবসময় কার্যকর নয়। কারণ এটি ভয় তৈরি করতে পারে, ব্যক্তি আচরণ লুকিয়ে করতে শিখে, পারস্পরিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভুল সংশোধন হয় না, শুধু কাজ থেমে যায়
তাই 'শাস্তি' নয় 'সঠিক আচরণের পুরস্কার' অনেক বেশি শক্তিশালী।
মানুষ ও প্রাণী দু'জনেই শেখে পুরস্কারের মাধ্যমে-
অপারেন্ট কন্ডিশনিং শুধু মানুষের নয়; প্রাণীজগৎেও গুরুত্বপূর্ণ। সার্কাসের বাঘ লাফ দেয় কারণ পুরস্কার হিসেবে খাবার পায়। পোষা কুকুর নির্দেশে বসে পড়ে কারণ পরে আদর পায়। পাখি নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য সন্ধান করে কারণ পরিবেশ থেকে পুরস্কারের ইঙ্গিত পেয়েছে।একইভাবে মানুষও সামাজিক পুরস্কার, আর্থিক পুরস্কার, স্বস্তি, প্রশংসা এসবের ওপর নির্ভর করে আচরণ গড়ে তোলে।
২) কাজে সময়মতো উপস্থিত হওয়া-
যদি দেরিতে এলে নোটিস দেওয়া হয়,এটি শাস্তি। যদি সময়মতো এলে প্রশংসা বা সুবিধা পাওয়া যায়, এটি পুরস্কার। ফলে সময়নিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
৩) অভিভাবকের ভূমিকা-
শিশু যখন ভালো আচরণ করলে প্রশংসা পায়, তখন সে তা শিখে। কিন্তু শুধু শাস্তি দিলে আচরণ সংকুচিত হয়, ভয় পায়; কিন্তু শেখে না।
৪) ট্রাফিক নিয়ম মানা-
জরিমানা হলো শাস্তি, দুর্ঘটনা ঠেকানো নেগেটিভ রিইনফোর্সমেন্ট (সম্ভাব্য কষ্ট এড়ানো)। দুটি মিলেই আচরণকে স্থায়ী করে।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়- পুরস্কার দিলে মস্তিষ্কে dopamine release হয়। ডোপামিন নতুন 'নিউরাল পাথওয়ে' গড়ে তোলে, যার মাধ্যমে আচরণটি পুনরাবৃত্তির প্রবণতা বাড়ে। শাস্তি দিলে cortisol বাড়ে, যা আবার ভয়, উদ্বেগ বা প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। তাই পুরস্কার-ভিত্তিক শেখা মানুষের জন্য আরও মানানসই।
আচরণ গঠনের চার ধরনের শক্তিবৃদ্ধি সময়সূচি (Reinforcement Schedule)-
প্রতিটি সময়সূচিই আচরণ শেখার গতি ও স্থায়িত্বকে বদলে দেয়।
১) Fixed Ratio: নির্দিষ্ট সংখ্যক কাজের পর পুরস্কার।
যেমন-১০টি কাজ শেষ করলে বোনাস।
২) Variable Ratio: কখন পুরস্কার আসবে জানা যায় না, কিন্তু আচরণ অব্যাহত থাকে। যেমন—অনিয়মিতভাবে গেমে রিওয়ার্ড পাওয়া। এটি আচরণ শক্তিশালী করে। এ কারণেই মানুষ অনেকে গেম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আটকে থাকে।
৩) Fixed Interval: নির্দিষ্ট সময় পেরোলে পুরস্কার।যেমন—মাস শেষে বেতন।
৪) Variable Interval- সময়ের ব্যবধান অনিশ্চিত। যেমন—কখন মেইল রিপ্লাই আসবে ঠিক নেই—তাই বারবার চেক করা।
এমন সূক্ষ্ম প্যাটার্ন আমাদের অজান্তেই আচরণকে গড়ে তোলে।
শিক্ষায় এর ব্যবহার-
আজকের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাত্রকে শাস্তি দিয়ে নয় বরং পুরস্কার, উৎসাহ, গাইডিং-এর মাধ্যমে শেখাতে চায়। যেমন—
⇨ ভালো কাজের স্টিকার
⇨ পয়েন্ট ভিত্তিক লার্নিং
⇨ ক্লাসে প্রশংসা
⇨ প্রকল্পে সৃজনশীলতার স্বীকৃতি
এতে শিশুর আগ্রহ, আত্মবিশ্বাস, ও শেখার গতি বাড়ে।
কর্মক্ষেত্রে আচরণ ব্যবস্থাপনা
কর্পোরেট সংস্কৃতিতে-
⇨ বোনাস
⇨ ইনক্রিমেন্ট
⇨ মাসের শ্রেষ্ঠ কর্মী
⇨ নমনীয় সময়সূচি
এগুলো সবই পুরস্কার-নির্ভর। শাস্তি নয়, বরং 'সক্রিয় প্রণোদনা' উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।
প্রযুক্তি এখন মানুষের আচরণকে সূক্ষ্মভাবে পরিচালনা করে। সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন, অ্যাপের streak system, গেমের reward loop- এগুলো অপারেন্ট কন্ডিশনিংয়ের আধুনিক প্রয়োগ। ডিজিটাল পুরস্কার মানুষকে বারবার ফিরে আসতে বাধ্য করে। এই কারণেই 'ডিজিটাল আসক্তি' শব্দটি ক্রমশ প্রচলিত হচ্ছে।
কীভাবে আমরা জীবনে এই তত্ত্ব প্রয়োগ করতে পারি?
⇨ অভ্যাস গড়তে ছোট পুরস্কার নির্ধারণ করুন
⇨ শিশুদের শেখাতে শাস্তির বদলে প্রশংসা ব্যবহার করুন
⇨ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে 'অসুবিধা এড়ানোর' পথ ব্যবহার করুন
⇨ কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের উৎসাহ দিন
⇨ সোশ্যাল মিডিয়ার 'পুরস্কার লুপ' সম্পর্কে সচেতন থাকুন
⇨ নিজের অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করুন-কোন পুরস্কার কী আচরণ বাড়াচ্ছে?
আচরণ বোঝা মানে নিজের জীবনকে আরও স্পষ্টভাবে অনুভব করা।
পুরস্কার ও শাস্তি শুধু শব্দ নয়; এগুলো মানুষের আচরণের অদৃশ্য চালিকাশক্তি। এগুলো আমাদের প্রতিক্রিয়া, অভ্যাস, রুটিন, এমনকি ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত আকার দিতে পারে। অপারেন্ট কন্ডিশনিং শেখায়-আচরণ জন্মগত নয়; আচরণ তৈরি হয়। আর এই তৈরির প্রক্রিয়ায় সচেতনভাবে পুরস্কার ব্যবহার করলে জীবন হয়ে ওঠে সুশৃঙ্খল, সম্পর্ক হয় মজবুত, এবং শেখা হয় সহজ। মানবজীবন এক চলমান শিক্ষার পথ, যেখানে প্রতিটি পুরস্কার আমাদের এগিয়ে দেয়, আর প্রতিটি ভুল আমাদের নতুন পথ দেখায়। আচরণকে বুঝতে পারলে মানুষ নিজেকেই নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।