গাছ বাঁচাতে হিমশিম? মনস্টেরা কেয়ারে নতুনদের সবচেয়ে বড় ভুলগুলো এখনই জেনে নিন!

গাছ বাঁচাতে হিমশিম? মনস্টেরা কেয়ারে নতুনদের সবচেয়ে বড় ভুলগুলো এখনই জেনে নিন!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ঘরের কোণে একটি মনস্টেরা রাখলে পুরো ঘরটাই যেন প্রাণ ফিরে পায়। সবুজের সেই আইকনিক কাটাকাটা পাতা যে শুধু সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, তা নয়। ইনডোর উদ্ভিদের জগতে মনস্টেরা এমন একটি গাছ, যাকে নিয়ে গবেষণা, পরীক্ষণ এবং উদ্ভিদবিদদের বিশেষ আগ্রহ কখনোই কমেনি। কারণ, এই গাছ যেমন দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে, তেমনই ঘরের বাতাসেও প্রাকৃতিক ভারসাম্য এনে দেয়। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, মনস্টেরা 'সহজ' বলে যে–কোনো যত্ন দিলেই টিকে যাবে। বাস্তবে বিষয়টি পুরোপুরি আলাদা। এই গাছ সহজ হলেও এর রয়েছে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যাত কিছু মৌলিক নিয়ম, যা শুরুতেই জানা না থাকলে গাছ শুকিয়ে যাওয়া, পাতা হলুদ হয়ে পড়া বা বৃদ্ধি থেমে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।

মনস্টেরা আসলে কেমন গাছ?

মনস্টেরা মূলত মধ্য আমেরিকার রেইনফরেস্টে জন্মানো একটি 'এপিফাইটিক' স্বভাবের গাছ। অর্থাৎ এটি মাটি ছাড়াও বড় গাছের গুঁড়িতে ভর করে উপরে উঠতে পারে। ঘরের ভেতরে যে মনস্টেরা দেখা যায়, বিশেষ করে Monstera deliciosa, Monstera adansonii —সেগুলো অনেকটাই 'শুরুর জন্য উপযোগী' কারণ:

⇨ কম আলোতেও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা

⇨ দ্রুতবর্ধনশীল শিকড়

⇨ পাতার নিজস্ব ফটোসিন্থেসিস দক্ষতা

⇨ পানি ধরে রাখার ক্ষমতা
 

রেইনফরেস্টের পরিবেশ অনুযায়ী মনস্টেরা প্রকৃতিগতভাবে আর্দ্রতা, পরোক্ষ আলো এবং মাঝারি তাপমাত্রা পছন্দ করে। অর্থাৎ এটিকে ভালো রাখতে হলে আপনাকে ঘরের ভেতর তার সেই 'জঙ্গলের অনুভূতি' সামান্য হলেও তৈরি করে দিতে হবে।

বেশিরভাগ নতুন গাছপ্রেমী মনে করেন মনস্টেরা অল্প আলোতেও বেঁচে থাকতে পারলে রোদ দরকার নেই। কিন্তু সত্য হলো—

মনস্টেরা পরোক্ষ উজ্জ্বল আলো চাই।কারণ আলো কম হলে পাতায় বিখ্যাত ছিদ্র (fenestration) গঠিত হয় না। আবার ডাঁটা লম্বা হয় কিন্তু পাতার আকার ছোট থাকে। তাছাড়া গাছ দুর্বল, পাতলা ও নুইয়ে পড়ে। অতিরিক্ত আলোতেও আবার পাতা পোড়া দাগ,ডগা শুকিয়ে যাওয়া, পাতার সবুজ রং হারানো ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়।

মনস্টেরার পাতায় 'chlorophyll a' ও 'chlorophyll b' বেশি পরিমাণে থাকে, যা মধ্যম আলোতে সর্বোচ্চ দক্ষতায় আলো শোষণ করতে পারে। অতিরিক্ত আলোতে ক্লোরোফিল ভেঙে যায়। ফলে পাতা বাদামি দাগ ফেলে।

জানালার পাশে উজ্জ্বল indirect আলো, পূর্ব বা উত্তরমুখী জানালা সবচেয়ে ভালো।তীব্র রোদ এলে পাতার সামনে পাতলা পর্দা ব্যবহার করুন
 

মনস্টেরার যত্নে পানির সঠিক নিয়ম না জানার কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়।মনস্টেরার নিয়ম হলো - "Water thoroughly, but not frequently." অর্থাৎ পানি কম নয়, বরং ভালোমতো ভেজানো দরকার। কিন্তু কখন পানি দেবেন  তা মাটি শুকানোর ওপর নির্ভর করে-

◑ মাটির উপরের ২–৩ ইঞ্চি শুকালে

◑ গাছের ডাঁটা নরম লাগলে না

◑ পাতা নুইয়ে গেলে নয়। এটা দেরিতে পানির সংকেত

 

অতিরিক্ত পানি দিলে যা হয়-

◑ শিকড় পচে যায়

◑ ছত্রাক বাসা বাঁধে

◑ পাতা হলুদ হয়ে পড়ে
 

মনস্টেরার শিকড়ে থাকে 'aerenchyma' নামে বিশেষ টিস্যু, যা অক্সিজেন পরিবহন করে। অতিরিক্ত পানি দিলে এই টিস্যুর কোষগুলো অক্সিজেন পায় না। ফলে শিকড় পচে যেতে শুরু করে।
 

মনস্টেরা নিজস্ব পরিবেশে মাটির ওপর নির্ভর করে না, বরং ঢিলা ও বাতাস চলাচলকারী সাবস্ট্রেট পছন্দ করে। সেরা মাটির বৈশিষ্ট্য হলো পানি দ্রুত বের হয়ে যাবে, কিন্তু সামান্য আর্দ্রতা ধরে রাখবে। শিকড় জমাট বাঁধবে না।

যে মিশ্রণ নবীনদের জন্য আদর্শ:

◑ নারিকেলের ছোবড়া (coco peat)

◑ পারলাইট

◑ বার্ক (পাইন বার্ক)

◑ অল্প পরিমাণ গার্ডেন সয়েল

 

এ ধরনের মিশ্রণ গাছকে দেয়-

◑ শ্বাস নিতে সুবিধা

◑ দ্রুত বৃদ্ধি

◑ রোগ কম হওয়া
 

মস্ পোল বা সাপোর্ট-কেন এটি প্রয়োজন?

মনস্টেরা একটি climbing plant।অর্থাৎ উপরে উঠতে চায়। শিকড় মস বা বার্ক থেকে আর্দ্রতা পায়, বড় ও ছিদ্রযুক্ত পাতা জন্মায়, গাছ সোজা থাকে, নান্দনিকতা দ্বিগুণ হয়। মস পোল ভিজা রাখলে aerial roots সেখানে লেগে যায় এবং গাছ আরও দ্রুত বাড়ে।
 

রেইনফরেস্টের গাছ হওয়ায় মনস্টেরা আর্দ্রতা পছন্দ করে।এর আদর্শ আর্দ্রতা ৬০–৭৫%। আর্দ্রতা কম হলে ডগা বাদামি হওয়া খুব স্বাভাবিক। আর্দ্রতা বাড়ানোর প্রাকৃতিক উপায়:

◑ গাছ একসঙ্গে রাখুন

◑ পানি ভর্তি ট্রে ব্যবহার করুন

◑ রুম হিউমিডিফায়ার ভালো সমাধান
 

পাতার 'stomata' আর্দ্রতা কম হলে দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গাছের ফটোসিন্থেসিস ধীর হয়। এতে গাছের পুষ্টি ও পানির গ্রহণ কমে যায়, পাতা দুর্বল হয়।

মনস্টেরা ঠান্ডা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। উপযুক্ত তাপমাত্রা: ১৮–২৮°C।  ১০°C–এর নিচে নামলেই পাতায় কালচে দাগ, বৃদ্ধি বন্ধ, শিকড়ে ক্ষতি হয়। আবার গরমে ৩০°C–এর বেশি হলে পাতা নুইয়ে পড়ে, পানি দ্রুত বাষ্পীভূত হয়।
 

সার অতিরিক্ত দিলেও ক্ষতি। নবীনদের বড় ভুলই হলো বেশি সার দিলে গাছ বেশি বাড়বে।বেশি সার দিলে পাতার ডগা পোড়া, শিকড়ে রাসায়নিক লবণ জমে, পানি শোষণ কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

বাস্তবে মনস্টেরা খুব কম সারেই বেঁচে থাকে। সার দেওয়ার নিয়ম:

◑ মাসে একবার

◑ NPK-balanced liquid fertilizer

◑ শীতে সার কম দিন

 

এর মাটি বেশি মানেই বৃদ্ধি কম। অনেকে মনে করেন বড় টবে লাগালে গাছ দ্রুত বাড়বে। কিন্তু অতিরিক্ত মাটি বেশি দিন ভিজে থাকে। ফলে শিকড় পচে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। সঠিক নিয়ম:

⇨ বর্তমান পটের চেয়ে সামান্য বড় টব

⇨ নিচে ড্রেনেজ হোল অবশ্যই থাকতে হবে

 

রোগ–বালাই কেন হয় এবং কীভাবে প্রতিরোধ করবেন?

মনস্টেরা তুলনামূলক রোগ কমে আক্রান্ত হয়, তবে ভুল যত্নে সমস্যা দেখা দেয়।

সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা ও কারণ:

১. পাতা হলুদ হয়ে যায় -অতিরিক্ত পানি, আলো কম, পুষ্টি ঘাটতি হলে।

২. বাদামি ডগা - আর্দ্রতা কম, পানি কম, অতিরিক্ত সার দিলে।

৩. পাতায় কালো দাগ দেখা দেয় -ঠান্ডা, ছত্রাক।

সমাধান হিসেবে পরিবেশ ঠিক করা, আক্রান্ত পাতা কেটে ফেলা এবং মাটি পরিবর্তন কার্যকর।
 

মনস্টেরার বড় পরিচয় তার ছিদ্রযুক্ত পাতা। কিন্তু নতুন পাতায় ছিদ্র না হলে সাধারণত দুটি কারণ থাকে:

⇨ আলো কম

⇨ সাপোর্ট না থাকা

ফেনেস্ট্রেশন আসলে গাছের উন্নত ফটোসিন্থেসিসের ফল, যা ঠিকমতো আলো না পেলে হয় না।
 

নবীনদের জন্য মনস্টেরা বেছে নেওয়ার একটি বড় কারণ। এটি খুব সহজেই ঘরে বংশবৃদ্ধি করে।

প্রক্রিয়া:

⇨ নোডসহ ডাঁটা কাটুন

⇨ পানিতে রাখুন

⇨ ১–৩ সপ্তাহে শিকড় হবে

⇨ পরে মাটিতে রোপণ করুন

এটি এত সহজ কারণ মনস্টেরার কাণ্ডে প্রাকৃতিকভাবেই 'adventitious roots' গঠনের ক্ষমতা থাকে।

 

কেন মনস্টেরা এত জনপ্রিয়? 

ঘরের বাতাসে আর্দ্রতা ও অক্সিজেন ভারসাম্য রাখে, আলো কম পেলেও বেঁচে থাকে। পাতার নকশা ঘরের সৌন্দর্য বাড়ায়। অন্যান্য গাছের তুলনায় রোগও কম। মনস্টেরার পাতার বড় আকার ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও বায়ু চলাচলের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে, যা গবেষণায় প্রমাণিত।

মনস্টেরা শুধু একটি ইনডোর প্ল্যান্ট নয়; এটি এমন একটি উদ্ভিদ যা ঘরের পরিবেশকে প্রাণবন্ত, সতেজ এবং নান্দনিক করে তোলে। তবে গাছটি যত সহজই হোক, কিছু বৈজ্ঞানিক নিয়ম মানলে এর সৌন্দর্য ও বৃদ্ধি হবে চোখে পড়ার মতো। মনস্টেরাকে ভালো রাখতে আপনাকে রাজ্যের জ্ঞান লাগবে না। শুধু আলো, পানি, মাটি, আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার একটি ব্যালান্স তৈরি করতে হবে। আর একবার সেই ব্যালান্স মিলিয়ে ফেলতে পারলেই আপনার মনস্টেরা হবে সুস্থ, বড়, আকর্ষণীয় এবং দীর্ঘজীবী।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ