যানজট, নগর পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র বদলে দিচ্ছে উড়ন্ত গাড়ি!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্বজুড়ে শহরগুলো যখন যানজটে বিপর্যস্ত, তখন নতুন স্তরের পরিবহন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভবিষ্যতের কল্পচিত্র হিসেবে ধরা হলেও, বাস্তবতায় উড়ন্ত গাড়ির প্রযুক্তি এখন দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। গবেষণা, স্টার্টআপ, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান সব ক্ষেত্রেই আকাশে চলা এই যান বাস্তব পরীক্ষার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে শুধু পরিবহন নয়, শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সবখানেই এই প্রযুক্তি বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে চলেছে। নগর এলাকাগুলো এখন বুঝতে পারছে আকাশপথে ব্যক্তিগত পরিবহন সক্রিয় হলে সড়কের উপর চাপ কমবে, সময় বাঁচবে, জরুরি সেবা দ্রুত চলাচল করতে পারবে। আর সেই পরিবর্তনকে সফল করতে প্রয়োজন সমসাময়িক প্রযুক্তি শিক্ষা, যেখানে ছাত্রছাত্রীদের হাতে–কলমে শিখতে হবে নতুন প্রযুক্তির কাঠামো, নকশা, সফটওয়্যার এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
উড়ন্ত গাড়ি আসলে কী?
সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে, উড়ন্ত গাড়ি হলো এমন একটি যান, যা প্রয়োজন অনুযায়ী রাস্তা এবং আকাশ দুই পথেই চলতে সক্ষম। এটি মূলত বৈদ্যুতিক মোটর, বহুমুখী রোটর সিস্টেম, স্বয়ংক্রিয় নেভিগেশন, সেন্সর প্রযুক্তি এবং উন্নত ব্যাটারি ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। অধিকাংশ ডিজাইনে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে- শব্দ কম হয়, দূষণ কম ছড়ায় এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হয়। এটি শহরের জন্য সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সমাধান। পাখার বদলে ড্রোন–স্টাইল বহুরোটর ব্যবহারের ফলে কম জায়গা থেকেও উড্ডয়ন ও অবতরণ সম্ভব, ব্যস্ত শহরের ভিড়েও আকাশে ওঠা নিরাপদ। উড়ন্ত গাড়ির সামনে, চারপাশে এবং নিচে একাধিক সেন্সর থাকে।এগুলো বাধা শনাক্ত করে, গতি নিয়ন্ত্রণ করে, উচ্চতা ও পথের নির্ভুল সমন্বয় করে।
উচ্চ শক্তি ধারণক্ষম ব্যাটারি ছাড়া উড়ন্ত গাড়ি সম্ভব নয়। তাই ব্যাটারি প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নই এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভরতা নির্ধারণ করছে।
কার্বন–ফাইবার কম্পোজিটের মতো উপাদান ব্যবহার করে গাড়িগুলোকে হালকা কিন্তু শক্তিশালী করা হয়। এই প্রতিটি প্রযুক্তিগত অংশই শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ক্ষেত্র, যেখানে গবেষণা, নকশা, তত্ত্ব–প্রয়োগ সব কিছুরই বিস্তৃত সুযোগ রয়েছে।
কেন শহরগুলো এখন উড়ন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে?
শহরের সড়ক বাড়ানো গেলেও যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। ফলে সড়ক–নির্ভর পরিবহন ক্রমশ অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আকাশপথে একটি নতুন পরিবহনস্তর তৈরি করলে সেই চাপ সরাসরি কমবে। যে যাত্রায় ৪০–৬০ মিনিট লেগে যায়, উড়ন্ত গাড়িতে তা নেমে আসতে পারে ৫–১০ মিনিটে। যাত্রী পরিবহন, ব্যবসায়িক ডেলিভারি, জরুরি সেবা সবকিছুই দ্রুত হবে।
উঁচু ভবনের ছাদে ছোট–মাপের "আকাশ–হাব" তৈরি করা যাবে, যেখানে গাড়ি ওঠানামা করবে। শহরের অতিরিক্ত জটিল অবকাঠামো বাড়ানো ছাড়াই একটি নতুন পরিবহন–নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। এছাড়া, বৈদ্যুতিক উড়ন্ত গাড়ি কার্বন নির্গমন কমাবে। শহরে শব্দ দূষণও নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে উন্নত রোটর ডিজাইনের মাধ্যমে।
প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর উড়ন্ত গাড়ির প্রত্যক্ষ প্রভাব
উড়ন্ত গাড়ির মূল চালিকাশক্তিই হলো আধুনিক প্রযুক্তি। ফলে শিক্ষা খাতে এর প্রভাব খুবই স্পষ্ট।
আগামী দিনে প্রযুক্তি পড়াশোনায় যুক্ত হবে অ্যারোডাইনামিক্স, হাই–এনার্জি ব্যাটারি, বৈদ্যুতিক প্রপালশন, স্মার্ট সেন্সর নেটওয়ার্ক, আকাশযান কন্ট্রোল সফটওয়্যার, হিউম্যান–মেশিন ইন্টারফেস। এই বিষয়গুলো ভবিষ্যতের টেক–ইনস্টিটিউটগুলোতে অপরিহার্য হয়ে উঠবে।
ব্যাটারির সীমাবদ্ধতা এখনো বড় বাধা। তাই ব্যাটারি রিসার্চ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের নতুন কোর্স প্রয়োজন।ড্রোন নির্মাণ, ছোট আকারের এয়ার–মডেল ডিজাইন এসব শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেবে, যা ভবিষ্যতের উড়ন্ত গাড়ি প্রযুক্তিতে ব্যবহার হবে।
শহরের অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনায় উড়ন্ত গাড়ি যে পরিবর্তন আনবে-
সড়ক যেমন: লেন, সিগন্যাল, স্পিড–লিমিটের ওপর চলে, আকাশেও একই ধরনের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট তৈরি করতে হবে। নতুন করে বড় জায়গা তৈরি না করেও বহুতল ভবনের ছাদ, ব্যবসা কেন্দ্র, হাসপাতালের ওপরের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যাবে।উড়ন্ত গাড়ি অ্যাম্বুলেন্স, জরুরি উদ্ধার এবং অগ্নিনির্বাপন - এসব ক্ষেত্রে সময় বাঁচাবে, যা শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনবে। স্বল্প দূরত্বের ডেলিভারি অনেক দ্রুত হবে। শহরের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।
উড়ন্ত গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়লে নতুন কয়েকটি পেশা ব্যাপক চাহিদা পাবে:
– এয়ার–মোবিলিটি ইঞ্জিনিয়ার
– ব্যাটারি টেকনিশিয়ান
– অটোনোমাস সিস্টেম ডেভেলপার
– ফ্লাইট কন্ট্রোল সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ
– শহুরে আকাশ–ট্রাফিক প্ল্যানার
– ডাটা বিশ্লেষক
– এয়ার–মেকানিক্স মেইনটেন্যান্স টেকনিশিয়ান
এই নতুন কর্মসংস্থান প্রযুক্তি শিক্ষাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছে।
চ্যালেঞ্জ:
☞ নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়ন: উচ্চতা, গতি এবং বাধা–এড়ানো সবকিছুই সেন্সরের ওপর নির্ভর। এটি নির্ভুল না হলে ঝুঁকি বাড়বে।
☞ শব্দ ও বাতাসের চাপ: রোটরের শব্দ এবং বাতাসের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে নতুন ডিজাইন দরকার।
☞ আবহাওয়া নির্ভরতা: বৃষ্টি, ধুলোঝড়, ঘূর্ণিঝড়-এগুলোর সময় আকাশপথে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
☞ আইন–নীতির অভাব: উড়ন্ত গাড়ির জন্য নতুন ট্রাফিক নিয়ম, বায়ু–নিরাপত্তা আইন এবং রুট–শৃঙ্খলা তৈরি না হলে এটি কার্যকর হবে না।
উড়ন্ত গাড়ি যেখানে আগামী পরিবহনের প্রধান স্তর হয়ে উঠতে পারে, সেখানে প্রযুক্তি শিক্ষাই এই পরিবর্তনের মূল ভিত্তি। কেবল নতুন যান আবিষ্কার নয়; শহুরে পরিকল্পনা, নিরাপত্তা, সফটওয়্যার, ব্যাটারি, নেভিগেশন সব ক্ষেত্রেই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি না হলে এই প্রযুক্তি বাস্তবে সফল হবে না।
একটা বিষয় পরিষ্কা যে শিক্ষা ব্যবস্থা আজ থেকেই ভবিষ্যতের এয়ার–মোবিলিটি প্রযুক্তি শেখাবে, সেই দেশ–শহরগুলোই আগামী দশকে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে। উড়ন্ত গাড়ির প্রযুক্তি শহরের অবকাঠামোকে বদলে দিচ্ছে, আর শিক্ষা ব্যবস্থা সেই পরিবর্তনের ভীত তৈরি করছে।অতএব আকাশে চলা পরিবহন আর কল্পনার গল্প নয়। এটি শহরের পরবর্তী বড় প্রযুক্তি বিপ্লব, যার কেন্দ্রে রয়েছে প্রযুক্তি শিক্ষা।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।