পরিবারের দৃঢ় ভিত্তি হয়ে থাকা বাবাদের নীরব চাপ, মানসিক যাত্রা ও মনস্তাত্ত্বিক ভার; নতুন গবেষণা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণ!

পরিবারের দৃঢ় ভিত্তি হয়ে থাকা বাবাদের নীরব চাপ, মানসিক যাত্রা ও মনস্তাত্ত্বিক ভার; নতুন গবেষণা ও বাস্তব পর্যবেক্ষণ!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

সমাজ তাকে শেখায় বাবা মানেই পাহাড়ের মতো মানুষ। কান্না তার জন্য নয়, দুর্বলতা তার চরিত্রে মানায় না, আর ক্লান্তি প্রকাশ করা তো যেন অপরাধ। অনেক পরিবারে এখনও বাবাকে দেখা হয় "চিরস্থায়ী সমর্থক" হিসেবে, যিনি দিন শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরেও সব সমস্যার সমাধান করবেন। কিন্তু এই শক্তির আবরণ ভেদ করে কেউ যদি একটু গভীরে তাকায়, তবে প্রকাশ পায় ভিন্ন এক বাস্তবতা। বাবাদের ভেতরে জমে থাকা মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং অপরিচিত এক নিঃসঙ্গতা। আজকের আধুনিক সমাজে মা যেমন যত্ন, সন্তান–লালন-পালন ও সামাজিক চাপের মুখোমুখি হন, ঠিক তেমনই বাবারও থাকে মানসিক চ্যালেঞ্জে ভরা এক ভিন্ন জগৎ। কিন্তু পার্থক্য হলো- বাবার চাপকে সমাজ এখনো স্বাভাবিক ভেবে নেয়।

একজন পুরুষ যখন বাবা হন, তার কাছে পৃথিবী পাল্টে যায়। শিশুর প্রথম কান্না তাকে আনন্দে ভাসায়, কিন্তু একই মুহূর্তে তাকে ঘিরে ধরে গভীর উদ্বেগ-"আমি কি ভালো বাবা হতে পারব?"

সন্তানের খাবার, নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ সবকিছুর দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। বাবারা নিজেরাই নিজেদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন: "সন্তানের কিছু অভাব হতে দেব না", "পরিবারের প্রতি আমার কর্তব্য নিখুঁত হতে হবে।"এই নিজস্ব প্রতিশ্রুতিই অনেক সময় মানসিক চাপের উৎস।

আমাদের সমাজে বাবা মানেই পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। এই প্রত্যাশা অনেক পরিবারের মুখে উচ্চারিত না হলেও বাবার ভেতরে গভীরভাবে স্থাপন হয়। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, চাকরির চাপ, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সব মিলিয়ে বাবারা অনেক সময় রাতে ঘুমাতে পারেন না। তাদের উদ্বেগ সাধারণত পরিবারের কেউ জানেও না।

শিশু জন্মের পর শুধু মায়েরই জীবন পাল্টায় না, বাবারও হরমোনাল পরিবর্তন, ঘুমের অভাব এবং দৈনন্দিন রুটিনের পরিবর্তন ঘটে।

গবেষণায় দেখা গেছে, নবজাতকের আগমনের পর বাবারও- টেস্টোস্টেরন কমে যায়, অক্সিটোসিন বাড়ে, কর্টিসল ওঠানামা করে। ফলে বাবারা আবেগপ্রবণ হন, নতুন দায়িত্বে মানিয়ে নিতে সময় লাগে, এবং কখনও কখনও উদ্বেগ জন্ম নেয়।

শিশুর রাতে কান্না, খাওয়ানো, নিরাপত্তা সবকিছুই বাবার ওপরও প্রভাব ফেলে। ঘুমের ঘাটতি মানসিক চাপ, খিটখিটে মেজাজ এবং একাগ্রতা কমিয়ে দেয়। "ভালো বাবা" হওয়ার সামাজিক চাপ বাবাদের আরও মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। তারা ভুল করতে ভয় পান।
 

কেন বাবারা নিজেদের মানসিক চাপ প্রকাশ করেন না?

সমাজ ও পরিবার বাবাকে শেখায়- "পুরুষের কষ্ট বলতে নেই, কান্নার দরকার নেই, মন খারাপ হলে তাকে শক্ত হতে জানতে হবে।" এই ভুল ধারণাগুলো বাবাদের ভিতরে চাপ তৈরি করে।  অনেকে মনে করেন-

বাবা মানেই সবসময়ের ঠান্ডা মাথার মানুষ। সমস্যা যত বড়ই হোক, সে ভেঙে পড়বে না। বাবা কখনো ক্লান্ত হয় না। বাবা সব জানে। এই ধারণাগুলো পুরুষদের দুর্বলতা আড়াল করতে বাধ্য করে।

বাবারা নিজের সমস্যাকে পরিবারের উপর চাপ হিসেবে ভাবেন। যে কথাটি তারা প্রায়ই মনে মনে বলেন: "আমি যদি দুর্বল হই, আমার পরিবার কে দাঁড় করাবে?"

বেশিরভাগ পুরুষ ছোটবেলা থেকেই শোনেন-"কান্না মেয়েদের ব্যাপার", "পুরুষ হলে কাঁদো না"।
তাই অবচেতনেই তারা নিজের আবেগ দমন করতে শিখে যায়। অনেকে মনে করেন মানসিক সহায়তা বা কাউন্সেলর মানেই দুর্বলতা।
 

পিতৃত্বে যে মানসিক চ্যালেঞ্জগুলো বাবাদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে

১. আর্থিক স্থিতির চাপ: বাড়তি খরচ, সন্তানের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, চাকরির স্থায়িত্ব - এইসব বিষয় বাবাদের মনে প্রতিনিয়ত দুশ্চিন্তা তৈরি করে।

২. সময়ের সমন্বয়: কাজ–পরিবার–নিজের সময়-এই তিনের ভারসাম্য রাখা অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

৩. সঙ্গীর মানসিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া: মায়ের শারীরিক–মানসিক পরিবর্তন বাবাদের উপরেও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, কারণ তারা সঙ্গীকে সমর্থন দিতে গিয়ে নিজের আবেগ গোপন করেন।

৪. নতুন দায়িত্বে নিজেকে যোগ্য প্রমাণের ভীতি: "আমি কি ভালো বাবা হতে পারছি?"-এই চিন্তাটা অনেক রাত পর্যন্ত বাবাদের মাথায় ঘুরতে থাকে।

৫. সামাজিক চাপ: বাবা মানেই আদর্শ শিক্ষায়, আচরণে, মূল্যবোধে সন্তানের প্রথম শিক্ষক।
এই প্রত্যাশা পূরণ করাও সহজ নয়।
 

মানসিক চাপ বাবাদের জীবনে যে প্রভাব ফেলে:

১. ক্লান্তি ও বার্নআউট: দীর্ঘদায়িত্ব, ঘুমের ঘাটতি, পরিকল্পনার চাপ সব মিলিয়ে বাবারা শারীরিক–মানসিক ক্লান্তিতে ভোগেন।

২. উদ্বেগ ও আত্মসমালোচনা: নিজেকে যথেষ্ট ভালো বাবা মনে না হলে তারা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েন।

৩. সম্পর্কের উপর প্রভাব: চাপ জমতে থাকলে সঙ্গীর সাথে সম্পর্কেও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়।

৪. কাজের দক্ষতা কমে যাওয়া: উদ্বেগ মনোযোগ কমিয়ে দেয়, যার ফলে কর্মক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
 

সমাজ কেন বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে কম নজর দেয়?

সমাজে মা'কে যত্নের কেন্দ্র হিসেবে ভাবা হয়।নিঃসন্দেহে মায়ের ওপর চাপ অনেক বেশি, তাই মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সমাজের দৃষ্টি থাকে। তবে এতে বাবার চাপকে অনেক সময় অদৃশ্য করে দেয়। মায়েরা কাঁদতে বা আবেগ প্রকাশ করলে তা স্বাভাবিক, কিন্তু বাবা করলে অনেকেই তা বুঝতে চায় না। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আজও সামাজিক আলোচনার ঘাটতি রয়েছে, বিশেষ করে পুরুষদের ক্ষেত্রে।
 

পরিবার কীভাবে বাবার মানসিক চাপ কমাতে পারে?

১. শ্রবণ–সমর্থন দেওয়া- বাবার কথাও শোনা জরুরি। পরিবারের সদস্যরা তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলে চাপ কমে।

২. দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া- সদস্যরা ছোট–বড় দায়িত্ব ভাগ করে নিলে বাবারা স্বস্তি পান।

৩. আবেগ প্রকাশে উৎসাহ দেওয়া- বাবাও মানুষ, তাঁরও আবেগ আছে—এই সত্যটা পরিবারকে মেনে নিতে হবে।

৪. বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া- একটা নির্দিষ্ট সময় বাবার ব্যক্তিগত বিশ্রামের জন্য রাখা জরুরি।

৫. প্রশংসা করা- বাবারা অনেক সময় নিজের কাজকে স্বাভাবিক মনে করেন।পরিবারের ছোট প্রশংসায় তাদের মানসিক শক্তি বাড়ে।

 

পিতৃত্বের ইতিবাচক দিক, যা বাবাদের মানসিকভাবে শক্ত রাখে!

১. সন্তানের সঙ্গে মানসিক বন্ধন: শিশুর হাসি বা একটুখানি আলিঙ্গন সব চাপ ভুলিয়ে দিতে পারে।

২. দায়িত্ব পূরণের সন্তুষ্টি: নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখা, এটি বাবাদের জন্য গর্বের বিষয়।

৩. নিজেকে আরও পরিপক্ব মনে হওয়া: পিতৃত্ব একজন পুরুষকে দায়িত্বশীল, পরিকল্পনামুখী ও আবেগগতভাবে পরিণত করে।


পিতৃত্ব শুধু একটি সম্পর্ক নয়; এটি এমন এক যাত্রা, যেখানে আনন্দের পাশাপাশি থাকে গভীর দায়িত্ব, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং মানসিক চাপ। বাবারা সমাজের অদৃশ্য শক্তি হয়ে থাকেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তারা দুর্বল হতে পারেন না। বাবাকে মানবিকভাবে দেখা, তার ক্লান্তি বোঝা, তার নিঃশব্দ সংগ্রামকে মূল্য দেওয়া, এটাই পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব।  একজন মা যেমনি মানসিকভাবে যত্ন পাওয়ার যোগ্য, তেমনি বাবা–ও সমান যত্ন, সমর্থন, ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার দাবিদার। বাবাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা বাড়লে পরিবার আরও সুস্থ হবে, সন্তান আরও সুরক্ষিত হবে, এবং সমাজ হবে আরও মানবিক।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ