কাগজের শব্দের বাইরে, মানবসভ্যতার দীর্ঘ পথচলার নিঃশব্দ সাক্ষী যে গ্রন্থাগার!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষ ইতিহাস জুড়ে প্রশ্ন করেছে, খুঁজেছে, লিখেছে, সংরক্ষণ করেছে, ঠিক সেই দীর্ঘ অনুসন্ধানের হাজার বছরের চিহ্ন একত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি স্থানে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জ্ঞান, সৃষ্টিকর্ম, গবেষণা, ভুল-শুদ্ধ, সংস্কৃতি, শিল্প, সমাজ সব মিলিয়ে কোথাও কি একটি জায়গায় ধরা পড়ে? যদি প্রশ্ন ওঠে, উত্তরটা স্পষ্ট-Library of Congress।এটি শুধু বইয়ের গুদাম নয়; এটি সময়কে ধরে রাখার এক নিঃশব্দ স্থাপনা, মানবসভ্যতার সবচেয়ে বিস্তৃত জ্ঞান-মানচিত্র।
বিশ্বে এমন কোনো ভাষা নেই যার শব্দ, গান, গল্প, নথি বা ইতিহাস অন্তত কোনো না কোনোভাবে এখানে নেই। এমন কোনো মানব-অভিজ্ঞতার শাখা নেই, যার ছোঁয়া এই গ্রন্থাগারের অলিগলিতে গিয়ে পৌঁছায় না।তাই প্রশ্ন শুধু "এতে কয়টি বই আছে?" নয় বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত, একটি গ্রন্থাগারের পরিধি কতটা হলে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বলা যায়?
একটি গ্রন্থাগারের শক্তি শুধু বই দিয়ে মাপা যায় না, মাপা যায় তার বৈচিত্র্য, সংগ্রহের পরিমাণ, সময়ের গভীরতা, এবং গবেষণা-সমৃদ্ধির দিক থেকে।Library of Congress (LoC) প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই শতাব্দী ধরে একটিই কাজ করেছে-জ্ঞান সংরক্ষণ।
আজ পর্যন্ত যা জানা যায়-
মোট সংগ্রহ (All items) প্রায় ১৭৮+ মিলিয়ন বা ১৭ কোটিরও বেশি দলিল, বই, ছবি, নথি, মানচিত্র, রেকর্ডিং, ভিডিও ইত্যাদি। বই ও মুদ্রিত উপকরণ (Printed books) আনুমানিক ৪ কোটি+।পাণ্ডুলিপি রয়েছে প্রায় ৭ কোটি+। মানচিত্র, চার্ট ও cartographic items প্রায় ৫০ লক্ষ+। ফটোগ্রাফ ও ভিজ্যুয়াল সংগ্রহ ১.৫ কোটিরও বেশি। অডিও রেকর্ডিং প্রায় ৪০ লক্ষের বেশি। শত শত ভাষায় সংগ্রহ, ৪৭০+ ভাষার উপকরণ রয়েছে।
গ্রন্থাগারের "আইটেম" বলতে এখানে শুধু বই বোঝায় না। মানব জ্ঞানের প্রতিটি অস্তরধারক উপাদান এখানে অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাস, বিজ্ঞান, রাজনীতি, আইন, সংস্কৃতি, উপনিবেশ, আদিবাসী সমাজ, সংগীত, শিল্প, মানচিত্র কোনো কিছু বাদ নেই। LoC সেই স্থান যেখানে একই তাকের ভিন্ন সেকশনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে-
◑ একটি দেশের জন্মের নথিপত্র,
◑ কোনো বিপ্লবের ঘোষণাপত্র,
◑ কোনো বিজ্ঞানীর খসড়া কাগজ,
◑ কোনো চিত্রশিল্পীর প্রাথমিক আঁকা এবং
◑ কোনো সাধারণ মানুষের বহু পুরোনো চিঠি।
এমন বৈচিত্র্যই তাকে করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও গভীর জ্ঞান-সংগ্রহশালা।
সংগ্রহ বাড়ার পেছনের পদ্ধতি:
১. কপিরাইট-ডিপোজিট ব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো প্রকাশনা-বই, গান, ম্যাপ, জার্নাল, ভিডিও প্রকাশিত হলেই কপিরাইট আইনের কারণে তার একটি কপি LoC-তে জমা দিতে হয়। ফলে প্রতিদিনই নতুন বই, নতুন পাণ্ডুলিপি, নতুন গবেষণা অবিরত যুক্ত হয়।
২. বহু ভাষার সংগ্রহ: Library of Congress বিশ্বের প্রায় সব ভাষার উপকরণ সংগ্রহ করে। বাংলা থেকে আরবি, সোয়াহিলি থেকে আইসল্যান্ডিক যে ভাষা বলবেন, তার কোনো না কোনো রূপ এখানে আছে।
৩. বহুমাত্রিক ফরম্যাট: শুধু লেখা নয় পুরনো মানচিত্র, যুদ্ধের সময়কার চিঠি, রাজনৈতিক বক্তৃতার রেকর্ড, প্রাচীন সুরের অডিও, শতাব্দীপ্রাচীন ফটোগ্রাফ, বিজ্ঞান পরীক্ষার নথি, চলচ্চিত্রের সংরক্ষিত রিল, হাজারো নোট, খসড়া, স্কেচ সব মিলিয়ে LoC একটি মাল্টি-ডাইমেনশনাল জ্ঞানভাণ্ডার।
৪. বছরজুড়ে নতুন সংগ্রহ: একটি বছরেই এখানে লাখ লাখ নতুন আইটেম যুক্ত হয় ক্রয়, দান, এক্সচেঞ্জ, সরকারি নথি সব মিলিয়ে একটি নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাহক প্রবাহ।
এই বিশাল সংগ্রহ কীভাবে মূল্যবান হয়?
একটি গ্রন্থাগার তখনই সফল হয়, যখন তার ভেতরের সংগ্রহ মানুষকে নতুন প্রশ্ন করতে শেখায়, নতুন সত্য খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করে। LoC সেই কাজ করছে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে।
বেশিরভাগ ঐতিহাসিক গবেষণা বিশেষত আমেরিকা ও বিশ্ব-ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নথি খুঁজতে প্রথমেই যায় LoC-এ। কারণ এখানে আছে-
◑ শতাব্দীপ্রাচীন নোট
◑ মূল ঘোষণাপত্র
◑ প্রিন্টেড পাণ্ডুলিপি
◑ সেসময়ের সংবাদপত্র
◑ যুদ্ধকালীন নথি
◑ বিজ্ঞানীদের ব্যক্তিগত জার্নাল
যেকোনো গবেষক জানেন, LoC মানেই তথ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আর্কাইভ।
একটি ভাষার শক্তি তার গল্পে।এখানে সংরক্ষিত-
◑ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মৌখিক কাহিনি
◑ বিলুপ্ত ভাষার অডিও রেকর্ডিং
◑ বিরল লোকগীতি
◑ প্রাচীন লিপি
এগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অপূর্ব সম্পদ।
শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক যে কেউ এখানে এসে জানতে পারে "কীভাবে" ও "কেন" একটি সমাজ বদলেছে। একটি জাতির রাজনীতি থেকে বিজ্ঞান সব রূপ এখানে আর্কাইভড।
LoC শুধুই কাগজ ভিত্তিক নয়, ডিজিটাল সংরক্ষণ অত্যন্ত উন্নত। দুর্লভ নথির উচ্চ-রেজোলিউশন ডিজিটাল কপি ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত রাখছে।
বিশ্বের অন্যান্য বিশাল গ্রন্থাগারের তুলনায় LoC কেন আলাদা?
ব্রিটিশ লাইব্রেরি, রাশিয়ান স্টেট লাইব্রেরি, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব চায়না সবগুলোই বড়। কিন্তু Library of Congress আলাদা কারণ—
⇨ সবচেয়ে বড় মোট সংগ্রহ
⇨ সংগ্রহে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্য
⇨ সময়ের সবচেয়ে বিস্তৃত নথি, শতাব্দীপ্রাচীন থেকে আধুনিক পর্যন্ত
⇨ কপিরাইট-ডিপোজিট পদ্ধতি, যা প্রতিদিন নতুন সংযোজন নিশ্চিত করে
⇨ বহুরূপ সাংস্কৃতিক দলিল
একা একটি দেশে শুধু নয় সারা পৃথিবীর জ্ঞান এখানে এসে থেমে থাকে।
ভাবুন, যদি আমাদের দেশে-শত বছরের সংবাদপত্র, দেশজ সংস্কৃতি, পুরনো চলচ্চিত্র লোকগীতি, প্রাচীন মানচিত্র, গবেষণার দলিল, হারিয়ে যাওয়া কাগজপত্র সব এক জায়গায় সংরক্ষিত থাকত তবে গবেষণা, শিক্ষা, ইতিহাসচর্চা সবই সহজ হতো। লোকসংস্কৃতি ভুলে যেত না। বাঙালি পরিচয়ের শিকড় আরও শক্ত হতো। বাংলাদেশেও যদি LoC-র মতো একটি সমৃদ্ধ আর্কাইভ তৈরি করা যায়, তবে তা হবে দেশের জ্ঞানযাত্রার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার হিসেবে Library of Congress প্রমাণ করেছে, মানুষ যতদিন প্রশ্ন করবে, ততদিন একটি জ্ঞানভাণ্ডারের প্রয়োজন থাকবে।১৭ কোটি দলিলের এই মহাসমাহার আমাদের শেখায় -সময়কে ধরে রাখতে হলে তথ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। বই, ম্যাপ, ছবি, গান, কাগজ সবই একদিন ইতিহাস হয়ে ওঠে। আজ LoC এমন একটি স্থাপনা, যেখানে, মানব সভ্যতা নিজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতকে এক সাথেই ধরে রেখেছে। এই কারণেই একটি প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হয়—বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার শুধু "বড়" নয়, এটি মানবজাতির স্মৃতি, সংগ্রাম ও সৃষ্টির মহাগ্রন্থ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।