বেগম খালেদা জিয়া: সাধারণ গৃহবধূ থেকে ‘আপসহীন দেশনেত্রী’ হওয়ার গল্প
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া। একসময়ের লাজুক গৃহবধূ থেকে তিনি নিজেকে রূপান্তরিত করেছেন আপসহীন নেত্রীতে, এবং পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। ব্যক্তিগত বিয়োগান্তক ঘটনা, দীর্ঘ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তার এই যাত্রাপথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করা বেগম খালেদা জিয়া (পৈতৃক নিবাস ফেনী)। ১৯৬০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাডেট অফিসার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসেন, তখনো বেগম জিয়া ছিলেন পুরোদস্তুর গৃহিনী। স্বামী, সন্তানদের দেখভাল করায় ছিল তাঁর প্রধান কাজ।
কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির অস্তিত্ব যখন সংকটের মুখে, তখন দলের নেতাকর্মীদের অনুরোধে ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে পা রাখেন। আর ১৯৮৪ সালে তিনি দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখল করলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে রাজপথে নামেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৮ বছর তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এ সময় তাকে সাতবার অন্তরীণ করা হয় এবং একাধিকবার গ্রেপ্তার হন। কিন্তু আপস না করে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করায় তিনি সাধারণ মানুষের কাছে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসে।
তার সরকারের শাসনামলে মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু করা হয়, যা নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রসার ঘটে।
বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে একটি অনন্য রেকর্ড হলো—তিনি তার জীবনে অংশগ্রহণ করা পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে সবকটিতেই জয়লাভ করেছেন। কোনো নির্বাচনেই তিনি পরাজিত হননি। তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে মোট তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিদেশে নির্বাসনে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়, যা তিনি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে (২০০৯-২০২৪) তিনি নজিরবিহীন রাজনৈতিক ও আইনি চাপের মুখে পড়েন। ২০১০ সালে তাকে তার ৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে দেওয়া হয় কারাদণ্ড । বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই এই ‘রাজনৈতিক চক্রান্তমূলক’ রায় দেওয়া হয়েছিল। কারাগারে থাকাকালীন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, তাকে সেখানে ‘স্লো পয়জনিং’ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
২০২৪ এ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পান। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে সম্প্রতি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা থেকেও তিনি খালাস পান এবং অন্যান্য মামলায় তার সাজা মওকুফ করা হয়।
স্বামী হারিয়ে দলের হাল ধরা, স্বৈরাচারের পতন ঘটানো, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীতে দীর্ঘ কারাভোগ—সব মিলিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার জীবন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। চরম প্রতিকূলতাতেও দেশ না ছাড়ার সিদ্ধান্ত এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস না করার মানসিকতাই তাকে সাধারণ গৃহবধূ থেকে ’আপোসহীন দেশনেত্রী’তে পরিণত করেছে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।