আপনার শহর কি নিরাপদ? জাপানের ভূমিকম্পে লুকানো শিক্ষা যা সবার জানা জরুরি !

আপনার শহর কি নিরাপদ? জাপানের ভূমিকম্পে লুকানো শিক্ষা যা সবার জানা জরুরি !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পৃথিবী, আমাদের অতি প্রিয় গ্রহ, যা আমরা কখনও কখনও শুধুই শান্তির, সৌন্দর্যের এবং অদ্ভুত বর্ণময় প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্যই স্মরণ করি, কিন্তু প্রকৃতির এই একই গ্রহ কখনও কখনও আমাদের সামনে নিজের ভয়ানক শক্তি, আমাদের ক্ষুদ্রতা এবং প্রস্তুতির সীমাবদ্ধতা উদ্ভাসিত করতে কোনো পূর্বানুমান ছাড়াই হাজির হয়।

২০১১ সালের ১১ মার্চ জাপানের পূর্ব উপকূলের মানুষরা এক বাস্তব অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখলেন, যে প্রাকৃতিক শক্তি শুধুমাত্র শহরকেই নয়, পুরো দেশকে, আর্থ-সামাজিক কাঠামোকেও অচল করে দিতে পারে এবং এমনকি পৃথিবীর অক্ষ এবং দিনের দৈর্ঘ্য পর্যন্ত পরিবর্তিত করতে পারে। এই দিনে জাপানের পূর্ব উপকূলে আঘাত হানা ৯.০ মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প, যা শুধু জনবসতিকে নয়, এমনকি বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর অক্ষকে প্রায় ১৭ সেন্টিমিটার সরিয়ে দেয় এবং দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৮ মাইক্রোসেকেন্ড কমিয়ে দেয়, প্রমাণ করে যে প্রকৃতি কখনও কখনও আমাদের সকল হিসাব, পরিকল্পনা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও চিরস্থায়ীভাবে অচল করতে পারে। এমন এক মুহূর্তে, জাপানের আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির দেশ হিসেবে থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১৯,৭০০ মানুষ প্রাণ হারান, আর্থিক ক্ষতিও প্রায় ২৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়ে দাঁড়ায়, এবং যদিও ভূমিকম্পের তীব্রতার কারণে মূল শহরের ভবনগুলো বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, যা জাপানের উন্নত স্থাপত্য ও ভূমিকম্প প্রতিরোধী প্রযুক্তির সুবিধার প্রমাণ। তবুও পরবর্তী সুনামি এবং ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কুলিং সিস্টেমের অকেজো হয়ে যাওয়ায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়া, লক্ষাধিক মানুষকে তাদের নিরাপদ আশ্রয় ও ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য করে, যা দেখায় যে প্রকৃতির রূপ কখনও কখনও একাধিক ধাপের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে এক প্রাকৃতিক ঘটনা অন্যটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মানুষের জন্য এক অবর্ণনীয় দুর্যোগের চেইন রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করে।

এই ইতিহাসের ঘটনা শুধু একটি দেশীয় বিপর্যয় হিসেবে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের একটি বড় প্রশ্নে নিয়ে আসে- যদি জাপানের মতো পৃথিবীর সর্বোচ্চ প্রযুক্তি, উন্নত নগর পরিকল্পনা, শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত জরুরি সেবা থাকা দেশও এই প্রাকৃতিক শক্তির কাছে হার মানতে পারে, তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী ঢাকা, যেখানে নগরায়ন অসম্পূর্ণ, নির্মাণের মান নড়বড়ে এবং জনসংখ্যা অত্যাধিক ঘন, সেখানে এই ধরনের বিপর্যয় কতোটা বিধ্বংসী হতে পারে, এটি কল্পনাও করা যায় না।

রাজউক এবং বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকা শহরের খুব কাছেই অবস্থিত টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট এমন এক অদৃশ্য, কিন্তু বিপজ্জনক ভূমিকম্পের উৎস, যা মাত্র ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পও ঘটাতে সক্ষম। এই মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার প্রায় ৮,৬৫,০০০ ভবন ধসে পড়ার ঝুঁকিতে থাকে এবং দিনের বেলায় এই বিপর্যয় ঘটে গেলে প্রায় ২,১০,০০০ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে, আরও লক্ষাধিক মানুষ আহত হতে পারে, এবং দেশের অর্থনীতির জন্য প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি ঘটতে পারে, যা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য এক অপূরণীয় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হয়।

২০১৬ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় সতর্ক করা হয়েছে যে, গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকার তলদেশে একটি বিশাল 'মেগাথ্রাস্ট ফল্ট' সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যা প্রায় ৮.২ থেকে ৯.০ মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প সৃষ্টিতে সক্ষম। অর্থাৎ জাপানের মতো দেশও যেখানে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছিল, সেখানে প্রকৃতির বিপর্যয় অপ্রতিরোধ্য প্রমাণিত হয়েছে; আমরা যদি নগরায়ন ও অবকাঠামোগত মানের দুর্বলতা বিবেচনা করি, তবে ঢাকার মতো শহরের সম্ভাব্য বিপর্যয় অনুরূপ বা তার চেয়েও গুরুতর হতে পারে।

ধরে নিন, সকাল ৯টার দিকে ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিল, গুলশান বা শাহবাগ- এ হঠাৎ এক প্রলয়ংকরী কম্পনের তীব্রতায় কেঁপে ওঠে। রাস্তাঘাটে হাহাকার, যানবাহন থমকে যায়, ভবনগুলো কেঁপে ওঠে, মানুষের চিৎকার আর আতঙ্কিত পদচারণা শহরের আকাশে প্রতিধ্বনিত হয়। বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা এক মুহূর্তে স্থবির হয়ে যায়। হাসপাতালগুলো প্রাথমিক আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের ভিড় থেকে অতিপ্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে। উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত সড়ক ও ব্রিজের কারণে সময়মতো পৌঁছাতে পারছে না, ফলে ক্ষয়ক্ষতি বহুগুণ বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধী নয়। নির্মাণে মানদণ্ড অমান্য, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, এবং নিয়মিত তদারকির অভাব ভবনগুলিকে বিপর্যয়ের মুহূর্তে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শুধু প্রাণহানি নয়, দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবকাঠামোরও অমুল্য ক্ষতি হবে।
 

বিপর্যয় মোকাবেলার প্রস্তুতি:

যেখানে প্রকৃতি স্বজ্ঞানে unpredictable, সেখানে মানুষের প্রস্তুতি একমাত্র সুরক্ষা। জাপানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, সতর্কতা ব্যবস্থা, ভৌত অবকাঠামোর মান, জরুরি সেবা এবং নাগরিক সচেতনতা মিলিতভাবে বিপর্যয় মোকাবেলায় সহায়ক। বাংলাদেশেও সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব—নগরায়ন নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণ মান উন্নয়ন, ভূমিকম্প প্রতিরোধী অবকাঠামো, জরুরি সেবা বৃদ্ধি, এবং নাগরিক সচেতনতা প্রশিক্ষণ একসাথে বাস্তবায়ন করলে বিপর্যয়ের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যায়। প্রতিটি ভবন, স্কুল, হাসপাতাল এবং বাজারে ভূমিকম্প প্রতিরোধী ব্যবস্থা স্থাপন, নিয়মিত মহড়া এবং সতর্কতা প্রশিক্ষণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক। শুধু প্রযুক্তি নয়, সচেতন মানুষই প্রকৃত বিপর্যয়ের সময়ে সবচেয়ে বড় সুরক্ষা। নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিতকরণ, এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরির মাধ্যমে আমরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রভাব হ্রাস করতে পারি।

প্রকৃতির এই রুদ্ররোষের মুহূর্তে মানুষ শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও প্রভাবিত হয়। হঠাৎ প্রিয় মানুষ, বাড়ি, প্রিয় স্থান হারানো, আতঙ্ক এবং নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে চরম মানসিক চাপে ফেলে। এই মানসিক চাপ এবং আতঙ্ক দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক প্রভাবও তৈরি করে। জাপানের ভূমিকম্প ও সুনামির পর মানুষের মধ্যে মানসিক পুনরুদ্ধার এবং সমাজের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল সময় নিয়েছে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে যদি এমন বিপর্যয় ঘটে, তাহলে মানুষের মানসিক প্রস্তুতির পাশাপাশি সামাজিক সমন্বয় এবং পুনর্বাসনের তৎপরতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।

প্রকৃতির বিপদ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আসে, এবং যদি আমরা প্রস্তুত না থাকি, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি অপরিমেয় হবে। তবে, সচেতনতা, পরিকল্পনা, প্রযুক্তি, এবং নাগরিক উদ্যোগ একসাথে থাকলে আমরা বিপর্যয়ের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন পৃথিবীর অচেনা শক্তি, তেমনি প্রস্তুত মানুষ হলো সেই শক্তির বিপরীতে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরক্ষা। আমরা আজ সচেতন হই, আমাদের শহরকে নিরাপদ রাখি, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করি। এটাই প্রকৃত প্রস্তুতি এবং মানবিক দায়িত্ব। একটি শব্দে বলতে গেলে, প্রকৃতি হয়তো আমাদের জন্য কখনো বিরক্তিকর, কখনো বিধ্বংসী, কিন্তু মানবিক সচেতনতা, প্রস্তুতি, এবং প্রযুক্তির ব্যবহার এটিকে সীমিত করতে পারে, যাতে আমরা শুধু বেঁচে থাকি না, বরং নিরাপদে বাঁচি, আমাদের নগরকে রক্ষা করি, এবং আমাদের দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ