শতবর্ষের গ্রামের ভরসা শাপলার কন্দ: কেন এই কচি কন্দকে ডাক্তারও অবহেলা করতে পারেন না?

শতবর্ষের গ্রামের ভরসা শাপলার কন্দ: কেন এই কচি কন্দকে ডাক্তারও অবহেলা করতে পারেন না?
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

গ্রামের জলাশয়ে অবহেলায় পড়ে থাকা শাপলা। কিন্তু এর কন্দই একসময় ছিল ঘরোয়া চিকিৎসার শক্তিশালী উপাদান! পুকুর, বিল কিংবা হাওরের কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র-লাল শাপলার শোভা গ্রামবাংলায় খুব পরিচিত। কিন্তু এই সুন্দর জলজ উদ্ভিদ শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং স্বাস্থ্যরক্ষায়ও দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছে। বিশেষ করে শাপলার কন্দ (rhizome), যা গ্রামীণ চিকিৎসায় খাদ্য, পুষ্টি ও ওষুধ তিন রূপেই ব্যবহৃত হয়েছে।

স্থানীয় চিকিৎসকদের মতে, শাপলার কন্দে রয়েছে উচ্চ ফাইবার, প্রাকৃতিক স্টার্চ, খনিজ, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহনাশক উপাদান, যা নানা শারীরিক সমস্যায় কার্যকর বলে পরিচিত। 

যা যা পুষ্টি আছে-

গবেষণা অনুযায়ী শাপলার কন্দে রয়েছে-

⇨ প্রাকৃতিক স্টার্চ (উচ্চ শক্তি যোগায়)

⇨ ফাইবার (হজমে সহায়ক)

⇨ পটাশিয়াম (রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা)

⇨ ম্যাগনেশিয়াম ও আয়রন

⇨ প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট

⇨ ট্যানিন ও প্রদাহনাশক যৌগ
 

এই সমৃদ্ধ পুষ্টিগুণের কারণেই গ্রামাঞ্চলে এটি খাবার ও ওষুধ, উভয়ভাবেই ব্যবহৃত হয়।
 

গ্রামীণ স্বাস্থ্যরক্ষায় শাপলার কন্দের ব্যবহার

১) ডায়রিয়া ও পাতলা পায়খানা নিয়ন্ত্রণে:

শাপলার কন্দ সিদ্ধ করে খাওয়ানো গ্রামে প্রচলিত ছিল। এতে থাকা ট্যানিন অন্ত্রকে শান্ত করতে সাহায্য করে। এছাড়া, অতিরিক্ত পানি ক্ষরণ কমাতে সহায়ক। গ্রাম্য চিকিৎসকরা বলতেন, "শাপলার কন্দ পেটকে চাঙা করে।"

 

২) হজমের সমস্যা ও গ্যাস্ট্রিক শান্ত করতে:  

কন্দের উচ্চ ফাইবার ও মৃদু প্রদাহনাশক গুণ পেটের জ্বালা, গ্যাস ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে।

হালকা সিদ্ধ বা ভর্তা করে খাওয়া হয়।

 

৩) ত্বকের প্রদাহ, ফোঁড়া বা পোড়ায় পেস্ট ব্যবহার:

গ্রামবাংলায় শাপলার কন্দ বেটে পেস্ট করা হত-

◑ ত্বকের জ্বালা কমাতে

◑ হালকা পোড়া

◑ ফোঁড়ার ব্যথা কমানোর জন্য

◑ পেস্টে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান ত্বককে দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে।
 

৪) সর্দি–কাশিতে ঘরোয়া টনিক:

অনেক এলাকায় শাপলার কন্দ শুকিয়ে গুড়ো করা হতো। মধুর সঙ্গে মিশিয়ে সর্দি–কাশিতে খাওয়ানো হত। এতে গলা আরাম পায়।

 

৫) দীর্ঘক্ষণ শক্তি ধরে রাখতে 'স্ন্যাক' হিসেবে:

শাপলার কন্দে স্টার্চ বেশি, ফলে—

কৃষক, জেলে বা শ্রমিকরা দীর্ঘসময় কাজ করতে শক্তি পেতেন। শিশুদেরও পুষ্টি বাড়াতে দেওয়া হতো।

 

৬) নারীদের বিভিন্ন অসুস্থতায় ব্যবহৃত হত:

ঐতিহ্যগত চিকিৎসায় শাপলার কন্দ কখনো কখনো অতিরিক্ত রক্তপাত কমাতে, শরীরের দুর্বলতা দূর করতে ব্যবহৃত হতো।

 

৭) দেহের তাপ কমাতে 'কুলিং ফুড' হিসেবে:

গরম মৌসুমে শাপলার কন্দ সিদ্ধ করে খেলে শরীর ঠান্ডা রাখে বলে মনে করা হতো।

 

খাদ্য হিসেবে নিরাপদ ব্যবহার-

 শাপলার কন্দ সাধারণত সিদ্ধ, ভর্তা, ভাজি বা সুপ আকারে খাওয়া হয়। এটি বাচ্চা ও বৃদ্ধদের জন্য সহজপাচ্য। দীর্ঘসময় পেট ভরা রাখে। তবে যেসব জলাশয়ে কন্দ সংগ্রহ করবেন, সেটি পরিচ্ছন্ন ও রাসায়নিকমুক্ত হওয়া জরুরি।
 

স্থানীয় গবেষকদের মতে, শাপলার কন্দের পুষ্টিগুণ বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। ভবিষ্যতে এটির উপাদান থেকে বিভিন্ন হারবাল ওষুধ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শাপলা শুধু বাংলাদেশের জাতীয় ফুলই নয়।এ দেশের গ্রামীণ চিকিৎসা–সংস্কৃতিরও অংশ। জলাশয়ে সহজলভ্য এই কন্দ একসময় গ্রামের মানুষের শক্তি, পুষ্টি ও প্রাথমিক চিকিৎসার প্রধান ভরসা ছিল। আধুনিক চিকিৎসা আজ অনেক এগিয়েছে, তবু শাপলার কন্দের প্রাকৃতিক গুণাবলি এখনও উপকারী, নিরাপদ এবং বহুমাত্রিক। প্রকৃতির এই নীরব উপহার আজও মনে করিয়ে দেয়, স্বাস্থ্যরক্ষায় স্থানীয় খাদ্য ও উদ্ভিদের মূল্য কতটা গভীর।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ