গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইয়েদিওথ আহরোনোথ।
প্রতিবেদনে বলা হয় যে ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে ইসরাইলি জনগণর মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে বেড়ে যাওয়ায় পেশাদাররা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে থেরাপিস্ট এবং সহায়তা পরিষেবার তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা বিপর্যয়কর পরিণতি ঘটাতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গত সপ্তাহে, আটটি প্রধান মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার একটি জোট ইসরাইলি সরকারকে জরুরি সতর্কতা জারি করে দেশের পরিস্থিতিকে ‘গভীরতা এবং পরিধিতে অভূতপূর্ব মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। জোটটি এই সংকটকে ‘বিপর্যয়কর’ অভিহিত করে সরকারের কাছে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ দাবি করেছে।

জোটের মতে, ইসরায়েলি সমাজ ব্যাপক মানসিক যন্ত্রণার স্পষ্ট লক্ষণ দেখাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত এবং মানসিক আঘাত বহু মানুষকে হতাশা, উদ্বেগ, অনধিকারমূলক চিন্তাভাবনা (intrusive thoughts) এবং ক্লান্তি নিয়ে সংগ্রাম করতে বাধ্য করছে। পরিবার ও সম্প্রদায়গুলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এই সংস্থাগুলি সতর্ক করেছে যে এই সংকট এখনও তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তারা ‘গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্মিলিত আঘাত’ এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা ও আস্থার বোধে ক্রমবর্ধমান ভাঙনের বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, এই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে পারে।
জোটের ভাষায়, “ইসরায়েলি সমাজের মানসিক অবস্থা এবং সুস্থতা এমন এক তলানিতে পৌঁছেছে, যা আমরা আগে কখনো দেখিনি।“

ইয়েদিওথ আহরোনোথ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির তীব্র বৃদ্ধি ঘটেছে। বিশেষ করে-
বিষণ্নতা ও উদ্বেগঃ ২০২৪ সালে বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ রোগ নির্ণয়ের সংখ্যা ২০১৩ সালের রেকর্ডের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।

পিটিএসডি বৃদ্ধিঃ ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত প্রতি মাসে ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার’ (পিটিএসডি) রোগ নির্ণয় ৭০ শতাংশ বেড়েছে, যার ফলস্বরূপ ২৩,৬০০ নতুন রোগী যুক্ত হয়েছে।

শোকের লক্ষণঃ প্রায় অর্ধেক ইসরায়েলি এখন ক্রমাগত শোকের লক্ষণ প্রকাশ করছে।

ক্লিনিক্যাল প্রভাবঃ ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ৭ অক্টোবর থেকে থেরাপি সেশনে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বল্পমেয়াদি সাইকোথেরাপির ঘটনা ৪৭১ শতাংশ বেড়েছে, যা ২০২২ সালে ৩,৫০০ থেকে ২০২৪ সালে ২০,০০০-এ পৌঁছেছে।

হেল্পলাইন ও ঔষধের ব্যবহারঃ মানসিক স্বাস্থ্য হেল্পলাইনে ফোনের সংখ্যা ছয় গুণ বেড়েছে, এবং মানসিক ঔষধের ব্যবহার দ্বিগুণ হয়েছে। যুদ্ধের সময় ঘুমের ব্যাধি ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।


ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ক্ল্যালিট স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং মায়ার্স-জেডিসি-ব্রুকডেল ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭ অক্টোবরের হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ৫০ শতাংশ এখনও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। সাধারণ জনগণের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত কারণে গুরুতর কার্যকারিতা হ্রাস (severe functional impairment) নিয়ে ভুগছেন।
জোট সংগঠনগুলো বলছে, এই সংখ্যাগুলি শুধুমাত্র চিকিৎসা গ্রহণের চিত্র তুলে ধরে; বাস্তব পরিস্থিতি এর থেকেও অনেক বেশি গুরুতর।


ইসরাইলি গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়, হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেরাভ রথ দেশকে সতর্ক করে যে ক্লিনিকগুলি শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মাদক আসক্তি, বৈবাহিক সমস্যা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণের তীব্র বৃদ্ধির কথা জানাচ্ছে।
রথ জানায়, বর্তমানে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন আসক্তির ঝুঁকিতে রয়েছে, যেখানে ২০১৮ সালে এই হার ছিল প্রতি দশজনের মধ্যে একজন। এই বৃদ্ধিকে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে অভিহিত করেছে রথ।

ইসরায়েলি সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ডা. মেরিনা কুপচিক পুনর্বাসনে জরুরি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলে, “যদি আমরা দেশের মানসিক পুনর্বাসনে বিনিয়োগ না করি, তাহলে দুই বা তিন বছরের মধ্যে আমাদের আরও বেশি মূল্য দিতে হবে- কর্মদিবস হারানো, পারিবারিক ও সম্প্রদায়ের স্থিতিশীলতা এবং পেশাগত কার্যকারিতা হারানোর মধ্য দিয়ে।“

এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি জাতীয় উদ্ধার পরিকল্পনার ঘোষণা করেছে, যার আনুমানিক ব্যয় ১.৭ বিলিয়ন শেকেল (৫১৭ মিলিয়ন ডলার)।
এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা দ্বিগুণ করা, বেতন বৃদ্ধি, মানসিক হাসপাতালগুলির মান উন্নয়ন এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক পরিষেবা সম্প্রসারণ।

তবে ইসরায়েলের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা জোর দিয়ে বলে যে সংস্কার ব্যাপক হতে হবে।
ভেঙে পড়া মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ইসরায়েল সাইকোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপার্সন, শিক্ষাগত মনোবিজ্ঞানী ইওরাম শ্লিয়ার, মাত্র তিন মাসের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘মেন্টাল-হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট’দের ওপর নির্ভরতার সমালোচনা করেছে। যেখানে একজন পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন ক্লিনিকাল পেশাদারদের জন্য আট বছরের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়।

ডা. ইলানা ল্যাচ জানায় সামগ্রিক ব্যবস্থাটি ইতিমধ্যেই ভারাক্রান্ত। ডা ল্যাচ বলে, “রক্তপাত হওয়া ক্ষতের ওপর ব্যান্ডেজ লাগানো যায় না। মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একেবারে গোড়া থেকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।“