ঘোড়ার অতিসংবেদনশীল ইন্দ্রিয় কীভাবে বিপদ অনুভব করে, আচরণ বদলে ফেলে-জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
প্রাণিজগতের দ্রুততম ও সবচেয়ে সতর্ক প্রাণীদের তালিকায় ঘোড়া অন্যতম। দূর থেকে সামান্য শব্দ, গন্ধ বা নড়াচড়ার ইঙ্গিত পেলেই এ প্রাণী আচমকা অস্থির হয়ে ওঠে। কখনো কান খাড়া করে, কখনো লেজ নড়ে, কখনো পায়ের চাপ বাড়ে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও ঘোড়ার এই আচরণ কমেনি বরং আরও পরিস্কারভাবে বোঝা যায়- বিপদের সম্ভাবনা বুঝলেই ঘোড়ার দেহে একধরনের 'অ্যালার্ম সিস্টেম' সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘোড়ার চঞ্চলতা আসলে তার বেঁচে থাকার প্রাকৃতিক কৌশল। প্রকৃতিতে ঘোড়া ছিল শিকারি নয়, বরং শিকার হওয়া প্রাণী, যার প্রধান নিরাপত্তা ছিল দ্রুত ছুটে পালানো। হাজার বছরের বিবর্তন তাদের ইন্দ্রিয়কে এতটাই তীক্ষ্ণ করে গড়েছে যে মানুষের চোখ বা কানে যা ধরা পড়ে না, ঘোড়া তা অনেক আগেই অনুভব করে।
ঘোড়ার দৃষ্টি অনেকটা 'ওয়াইড অ্যাঙ্গেল'। মাথার দু'পাশে চোখ থাকার কারণে তারা প্রায় চারপাশই দেখতে পারে। দূরের ক্ষুদ্র নড়াচড়া, ছায়ার পরিবর্তন কিংবা ঘাসের অস্বাভাবিক দুলুনি- এসব তাদের দৃষ্টিতে খুব সহজেই ধরা পড়ে। বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই তারা মাথা উঁচু করে, গলা টেনে শ্বাস নেয় এবং চারপাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করে।
শুধু দৃষ্টি নয়, ঘোড়ার শ্রবণশক্তিও তাকে দ্রুত সতর্ক করে। তাদের কান আকারে বড় এবং বিভিন্ন দিকে ঘুরতে পারে, ফলে খুব দূরের সূক্ষ্ম শব্দও আলাদা করে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। কখনো মানুষের কাছে স্বাভাবিক বাতাসের শব্দ বলে মনে হলেও, ঘোড়া সেটিকে সম্ভাব্য বিপদের ইঙ্গিত হিসেবে নিতে পারে। এ কারণেই হঠাৎ কোনো শব্দ, টুক করে ভাঙা ডালের আওয়াজ বা ঝোপের ভেতর নড়াচড়ায় ঘোড়া দ্রুত লাফিয়ে ওঠে।
গন্ধও ঘোড়ার আরেক প্রাথমিক সতর্ক সংকেত। বাতাসে নতুন কোনো গন্ধ প্রবেশ করলেই তারা অনেকে অস্থির হয়ে ওঠে। শত্রুপক্ষের প্রাণী, অচেনা মানুষ, এমনকি মাটির পরিবর্তিত গন্ধ- এসবই ঘোড়ার স্নায়ুকে উত্তেজিত করে।
বিপদ টের পেলেই ঘোড়ার দেহে 'ফাইট অর ফ্লাইট' প্রতিক্রিয়া সক্রিয় হয়। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তপ্রবাহ দ্রুতগতিতে পেশিতে পৌঁছায়, পা শক্ত হয়ে ওঠে। এই প্রতিক্রিয়া তাদের পালানোর জন্য প্রস্তুত করে, এটাই ঘোড়ার স্বাভাবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই পুরো প্রক্রিয়াটি এত দ্রুত ঘটে যে কয়েক সেকেন্ডেই আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ঘোড়ার এ আচরণ স্মৃতির সঙ্গেও সম্পর্কিত। তারা পরিবেশ আর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে বিপদ শনাক্ত করতে শিখে। আগের কোনো ভয়াবহ ঘটনায় কোনো বিশেষ গন্ধ, শব্দ বা দৃশ্য যুক্ত থাকলে ভবিষ্যতে তা অল্প ইঙ্গিতেই তাদের অস্থির করে তুলতে পারে।
গবেষকদের মতে, ঘোড়ার এই চঞ্চলতা তাদের দুর্বলতা নয়, বরং বেঁচে থাকা এবং সতর্কতার এক নিখুঁত কৌশল। মানুষের কাছে আচরণটি কখনো অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া মনে হলেও, প্রকৃতিতে এটি ছিল তাদের টিকে থাকার প্রধান অস্ত্র। তাই আজও ঘোড়া বিপদ সন্দেহ করলেই সতর্ক হয়, নড়াচড়া বাড়ায়, আর প্রয়োজন হলে মুহূর্তে ছুটে পালায়।
পরিশেষে বলা যায়, ঘোড়া শুধু একটি শক্তিশালী ও দ্রুতগামী প্রাণী নয়; বরং এটি এমন একটি ইন্দ্রিয়–সমৃদ্ধ জীব, যার প্রতিটি পদক্ষেপেই লুকিয়ে থাকে হাজার বছরের নিরাপত্তা–বিবর্তনের ইতিহাস। বিপদ টের পেলেই তাদের চঞ্চল হয়ে ওঠা, এটাই তাদের স্বভাব, আর এটাই তাদের বেঁচে থাকার বিজ্ঞান।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।