মাছ কেন একসঙ্গে দলে দলে সাঁতরে বেড়ায়-জানেন কি!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
নদী, সমুদ্র বা লেক যে পানিতেই তাকানো হোক, দল বেঁধে সাঁতার কাটতে থাকা মাছের দৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে। মানুষের কাছে এটি স্বাভাবিক ঘটনার মতো মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে দলবদ্ধ সাঁতার হলো মাছের প্রকৃতি–নির্ভর এক উন্নত বেঁচে থাকার কৌশল।এই আচরণ তৈরি হয়েছে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে, যেখানে বেঁচে থাকা, খাদ্য সংগ্রহ, শক্তি সাশ্রয় ও পরিবেশের বিপদে দ্রুত প্রতিক্রিয়া সবকিছু একসূত্রে গাঁথা।
যখন শত শত মাছ ঘূর্ণায়মান বা একই তালে সাঁতার কাটে, তখন তাদের দেহ ও আঁশে আলো প্রতিফলিত হয়ে শিকারির চোখে এক ধরনের চলমান আলোক–ঝাপটা তৈরি করে। এটাকে বিজ্ঞানীরা "মোশন কনফিউশন" বা 'গতি–বিভ্রান্তি' হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এই বিভ্রান্তির ফলে:
◑ শিকারি কোন মাছটিকে লক্ষ্য করবে তা বুঝতে পারে না
◑ আক্রমণ করার সময় ভুল লক্ষ্য বেছে নেয়
◑ আক্রমণের গতি কমে যায়
◑ সফল শিকারের সম্ভাবনা ৫০–৯০% পর্যন্ত কমে যেতে পারে (প্রজাতি অনুযায়ী ভিন্ন)
এ কারণে ছোট ও মাঝারি আকারের মাছ প্রায়ই ঝাঁক বেঁধে শিকারি ঠেকায়। এটি টিকে থাকার অন্যতম প্রধান কৌশল।
পানির নিচে সাঁতার মানেই প্রতিনিয়ত পানির প্রতিরোধের বিরুদ্ধে চলা। একটি বড় দল একসঙ্গে সাঁতার কাটলে সামনের মাছ পানিতে চাপ–প্রবাহের একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করে, যার ভেতরে থাকা পেছনের মাছগুলো অনেক কম শক্তিতে একই গতিতে চলতে পারে। এটি "হাইড্রোডাইনামিক ড্রাফটিং" নামে পরিচিত।
এর সুবিধা:
⇨ সাঁতারের সময় ২০–৩০% পর্যন্ত শক্তি সাশ্রয়
⇨ দীর্ঘ অভিবাসনপথে ক্লান্তি কমে
⇨ স্রোত কাটার সময় দলগত গতি স্থির থাকে
⇨ ছোট মাছও দ্রুতগতিতে শিকারি এড়িয়ে যেতে পারে
⇨ এই শক্তি সাশ্রয়ই অনেক মাছকে দূরদূরান্তের যাত্রায় সক্ষম করে, বিশেষ করে যেসব প্রজাতি ⇨ মৌসুমি পরিবেশ বদলের প্রতিক্রিয়ায় ভ্রমণ করে।
পানির নিচে খাবার খুঁজে পাওয়া সবসময় সহজ নয়। অনেক সময় খাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে, কখনও থাকে নির্দিষ্ট স্রোত–পথে।একটি মাছ একা খুঁজে পেতে অনেক সময় লাগলেও, দলবদ্ধভাবে খুঁজলে সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়ে। দলবদ্ধ খাবার–সংগ্রহের সুবিধা:
⇨ যে মাছটি আগে খাবারের উপস্থিতি টের পায়, তার আচরণ দেখে অন্যেরা দ্রুত সরে আসে
⇨ ঘ্রাণ ও কম্পন সংকেত পুরো দলে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে
⇨ খাদ্য সংগ্রহের প্রতিযোগিতা কমে, কারণ দলগতভাবে সবাই দ্রুত পৌঁছে যায়
⇨ খাদ্যের অবস্থান নির্ধারণে কম সময় লাগে
⇨ পানিতে থাকা ক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটন, পোকা বা ভাসমান উদ্ভিদের টুকরা সবকিছু দলবদ্ধতার কারণে সহজে পাওয়া যায়।
অনেক মাছ জীবনের নির্দিষ্ট সময় নদী থেকে সমুদ্রে বা সমুদ্র থেকে নদীতে যাতায়াত করে।
এই অভিবাসনের সময় পরিবেশের সংকেত-তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, স্রোত, আলো-সবকিছু একসঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে সঠিক পথ নির্ধারণ করতে হয়। দলে ভ্রমণ করলে:
⇨ পথ নির্ধারণের ভুল কমে
⇨ স্রোতের ভুল দিক এড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়
⇨ পিছিয়ে থাকা মাছও দলের সংকেতে এগিয়ে যেতে পারে
⇨ দলে থাকা মাছেরা পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রতি বেশি সংবেদনশীল থাকে
এই সমষ্টিগত নেভিগেশন কাঠামো দলকে একসঙ্গে রাখে এবং শত শত কিলোমিটার পথ অতিক্রমেও সঙ্গ হারায় না।
মাছের শরীর বিশেষ ধরনের সংবেদনশীল অঙ্গ দিয়ে ঘেরা, যাকে ল্যাটারাল লাইন সিস্টেম বলা হয়। এটি চারপাশে পানি কত দ্রুত বা ধীরে নড়ছে, চাপ কীভাবে বদলাচ্ছে-এসব তথ্য মুহূর্তে সংগ্রহ করে। দলে থাকলে এই তথ্য অনেক মাছের মধ্যে একসঙ্গে ছড়িয়ে যায়:
⇨ বিপদ শনাক্ত হলে পুরো দল একসঙ্গে দিক বদলাতে পারে
⇨ পানিতে হঠাৎ ধাক্কা লাগলে বা শব্দ হলেই দল বিভক্ত না হয়ে সমন্বিতভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়
⇨ কম অক্সিজেনযুক্ত এলাকায় ঢুকে পড়লে দল দ্রুত দিক পরিবর্তন করে নিরাপদ জলের দিকে সরে যায়।
এই 'তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা' দলবদ্ধতার বড় সুবিধা।
মানুষের চোখে মনে হয় মাছেরা যেন পূর্বপরিকল্পনা করে একসঙ্গে বাঁক নেয় বা ছন্দ মিলিয়ে সাঁতরায়।কিন্তু আসলে এটি সম্ভব হয় তাদের স্নায়ুতন্ত্রের অসাধারণ দ্রুত সংকেত–প্রবাহের কারণে। চারপাশে থাকা মাছের গতিবিধি ৪–৬ মিলিসেকেন্ডের মধ্যে বিশ্লেষণ। একই মুহূর্তে দিক পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া
পরিবেশগত চাপ–পরিবর্তনের প্রতি তাত্ক্ষণিক সাড়া।এই ব্যবস্থা মাছের দলে শৃঙ্খলাবদ্ধ ছন্দ তৈরি করে যা বাহ্যিকভাবে দেখলে মনে হয় যেন একটি বড় জীব একটানা নড়ছে।
ছোট আকারের মাছ বেশিরভাগ সময় শিকারির সহজ লক্ষ্য।কিন্তু দলে থাকলে একটি দলের ভেতর কোনো একক মাছ লক্ষ্যবস্তু হয় না।উল্টো দলের ঘনত্বের কারণে ছোট মাছ টিকে থাকার সুযোগ বেশি পায়। জৈবিকভাবে এটি দেখতে পাওয়া যায় এভাবে:
দলের ভিড়ে নিজের সিলুয়েট (দেহের ছায়া) ছোট হয়ে যায়। শিকারিও কোন নির্দিষ্ট মাছের দেহভঙ্গি বুঝতে পারে না। দলের গতিপ্রবাহ ভেঙে না গেলে ছোট মাছ সহজেই শিকারি এড়িয়ে ফেলে । এটি বিশেষভাবে লাভবান করে লার্ভা বা কিশোর মাছকে, যাদের বেঁচে থাকার হার স্বাভাবিকভাবেই খুব কম।
মাছের দলবদ্ধ সাঁতার শুধুই দৃষ্টিনন্দন নয়।এটি প্রকৃতির সবচেয়ে কার্যকর টিকে থাকার কৌশলগুলোর একটি, যেখানে শিকারি ঠেকানো, শক্তি সাশ্রয়, দ্রুত সংকেত আদান–প্রদান, নেভিগেশন, খাদ্য সংগ্রহ সব এক সঙ্গেই চলে। দলে থাকা মানেই বেশি নিরাপত্তা, কম শক্তি খরচ, বেশি খাদ্য সুযোগ এবং সবচেয়ে জরুরি, জীবনের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।