শব্দ নয়, নীরবতাই এখানে মারণ! জানুন কেন এই ঘরে কেউ টিকে থাকতে পারেনি ৪৫ মিনিটের বেশি

শব্দ নয়, নীরবতাই এখানে মারণ! জানুন কেন এই ঘরে কেউ টিকে থাকতে পারেনি ৪৫ মিনিটের বেশি
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আপনি কি কখনও এমন কোনো জায়গার কথা ভেবেছেন , যেখানে একটিও শব্দ নেই! না বাতাসের ফিসফিস, না পাখির ডাক, না নিজের নিঃশ্বাসের বাইরেও কোনো আওয়াজ! একদম পুরোপুরি নীরবতা। শুনতে শান্ত মনে হলেও, বাস্তবে এমন নীরবতা মানুষ সহ্য করতে পারে না। হ্যাঁ, পৃথিবীতে এমন এক ঘর আছে যেখানে কেউ ৪৫ মিনিটের বেশি থাকতে পারে না, কারণ অতিরিক্ত নীরবতা আমাদের মস্তিষ্ক ও ইন্দ্রিয়তন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দেয়

সে ঘরটি "নীরবতার কারাগার" হিসেবে পরিচিত

এই অদ্ভুত জায়গাটির নাম "Anechoic Chamber" (অ্যানেকোয়িক চেম্বার)।
এটি এমন এক বিশেষভাবে নির্মিত ঘর, যেখানে সব ধরনের শব্দ শোষিত হয়ে যায়, কোনো প্রতিধ্বনি বা রিফ্লেকশন তৈরি হয় না।বাইরের কোনো আওয়াজ ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না, আবার ভেতরের কোনো শব্দ বাইরে যেতে পারে না। এই ধরনের চেম্বার তৈরি করা হয় সাধারণত বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা শব্দপরীক্ষার জন্য। যেমন- স্পিকারের কার্যক্ষমতা, মাইক্রোফোনের সংবেদনশীলতা বা বিভিন্ন উপকরণের শব্দ শোষণক্ষমতা পরীক্ষা করা। কিন্তু এখানেই ঘটেছে এক আশ্চর্য ঘটনা। যারা এই ঘরে প্রবেশ করেছে, তারা বলেছে নীরবতার মধ্যে নিজ শরীরের শব্দই নাকি সহ্য করা যায় না।

আমরা সাধারণত প্রতিদিন বিভিন্ন পটভূমির শব্দে ঘেরা থাকি—পাখির ডাক, গাড়ির হর্ণ, পাখার শব্দ, মানুষের কথাবার্তা।এসব শব্দই আমাদের মস্তিষ্ককে "নিরাপত্তার সংকেত" দেয়। কিন্তু Anechoic Chamber–এর ভেতরে গেলে,এই সমস্ত বাহ্যিক শব্দ শূন্যে মিলিয়ে যায়। ফলে, আমাদের মস্তিষ্ক হঠাৎ এমন একটি পরিবেশে পড়ে, যেখানে বাইরের কোনো সাড়া নেই। তখন এটি নিজের ভেতরের শব্দগুলো "শোনা" শুরু করে।যেমন—নিজের হৃদস্পন্দন, রক্তপ্রবাহের ধ্বনি, এমনকি হাড়ের শব্দ পর্যন্ত। কেউ কেউ বলেছেন, তারা নিজের শ্বাসনালী দিয়ে বাতাস যাওয়া–আসার শব্দ শুনতে পেয়েছেন।কেউ আবার নিজের পেটের হজমের শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেছেন! এই অবস্থায় মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কারণ, সে আগে কখনও এত "অভ্যন্তরীণ আওয়াজ" শুনেনি।

ফলাফল??

মানুষের ভারসাম্য হারিয়ে যায়, মাথা ঘোরা, উদ্বেগ, এমনকি হ্যালুসিনেশন (অদৃশ্য জিনিস দেখা বা শোনা) শুরু হয়।

বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন: "Absolute Silence" আসলে অসম্ভব!

মানব কান তৈরি হয়েছে "পরিবেশের শব্দ" শুনে টিকে থাকার জন্য।যখন শব্দ নেই, তখন আমাদের মস্তিষ্ক 'অর্থহীন শূন্যতায়' আটকে যায়। Minnesota–এর একটি সাউন্ড ল্যাব–এ এই চেম্বারটি নির্মিত হয়েছিল গবেষণার উদ্দেশ্যে।এর ভেতরে শব্দমাত্রা মাইনাস ৯ ডেসিবেল (−9 dB)। অর্থাৎ, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত ঘর, যেখানে একটি সাধারণ ঘরে শব্দমাত্রা থাকে প্রায় ৩০–৪০ ডেসিবেল।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এত কম শব্দমাত্রায় মানব মস্তিষ্ক সংকেতহীন অবস্থায় চলে যায়। তখন শ্রবণতন্ত্র নিজেরাই শব্দ তৈরি করতে শুরু করে, যাকে বলা হয়, auditory hallucination। এমনকি অনেকে বলেন, নিজের হৃদয়ের প্রতিটি ধাক্কা এত জোরে শুনতে পান যে মনে হয় বুকের ভেতর থেকেই আওয়াজ বেরোচ্ছে।
 

কেন ৪৫ মিনিটের বেশি কেউ থাকতে পারে না?

যখন চারপাশে কোনো শব্দ নেই, তখন মানুষের মস্তিষ্ক অতি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। প্রতিটি ক্ষুদ্র শব্দ সে বাড়িয়ে শুনতে পায়।এই অবস্থায় মনোযোগ সম্পূর্ণ নিজের শরীরের দিকে চলে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় অস্বস্তি, ভয় এবং বিভ্রান্তি।প্রথম ৫ মিনিট হয়ত আকর্ষণীয় মনে হয়, কিন্তু ২০ মিনিট পরেই শুরু হয় মানসিক চাপ। ৩০ মিনিটের পর অনেকেই বলেন, "মনে হচ্ছিল, সময় থেমে গেছে"।আর ৪৫ মিনিট পেরোলে প্রায় সবাই বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন, কারণ তখন নিজের হৃদস্পন্দন বা শ্বাসের শব্দ এত জোরে শোনা যায় যে, তা অসহনীয় হয়ে ওঠে।

আমরা নীরবতাকে সাধারণত শান্তি, ধ্যান বা প্রশান্তির সঙ্গে যুক্ত করি। কিন্তু গবেষণা বলছে, সম্পূর্ণ নীরবতা মানে মানসিক শূন্যতা, যা মানুষ দীর্ঘক্ষণ সহ্য করতে পারে না। আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় কোনো না কোনো ইনপুট চায়।  যখন কিছুই নেই, তখন সে নিজেই শব্দ বা চিত্র তৈরি করে। এই কারণেই Anechoic Chamber–এ থাকা মানুষরা অনেক সময় বলেন, তারা অদ্ভুত আলো দেখেছেন,দূরে কারও হাঁটার শব্দ শুনেছেন, কিংবা মনে হয়েছে, কেউ পাশে দাঁড়িয়ে আছে।এগুলো আসলে বাস্তব নয়; মস্তিষ্কের sensor deprivation অবস্থায় তৈরি হওয়া হ্যালুসিনেশন।

তবে, এই ঘর ভয়ানক অভিজ্ঞতার হলেও, এটি বিজ্ঞানের জন্য অপরিহার্য। বিভিন্ন গবেষণাগারে এর সাহায্যে করা হয় স্পিকার বা হেডফোনের সাউন্ড টেস্ট, বিমানের ইঞ্জিন নয়েজ নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা, এবং এমনকি মহাকাশযানের অভ্যন্তরীণ শব্দসীমা নির্ধারণ।
NASA–র গবেষকেরা বলেছেন, এই ধরনের ঘরে নভোচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা মহাকাশের প্রায় নীরব পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে।
 

নীরবতার সীমা ও মানব সহ্যক্ষমতা-

মানবজাতি প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক ও শ্রাবণনির্ভর।তাই আমরা সম্পূর্ণ নীরবতা নয়, বরং সুষম নীরবতা–ই সহ্য করতে পারি। যেমন- বৃষ্টির শব্দ, বাতাসের সোঁ সোঁ, কিংবা দূরের পাখির ডাক। এসবই আমাদের মনকে শান্ত রাখে, কিন্তু মস্তিষ্ককে বিচ্ছিন্ন করে না। অন্যদিকে, Anechoic Chamber-এর মতো নীরবতা আমাদের শেখায় এক গভীর সত্য , শান্তি আর নীরবতা এক জিনিস নয়।
 

যে নীরবতাকে আমরা প্রশান্তির প্রতীক ভাবি,তারই গভীরে লুকিয়ে আছে এক ভয়ানক মানসিক অস্থিরতা।অতিরিক্ত শব্দ যেমন ক্লান্ত করে,অতিরিক্ত নীরবতাও মানুষকে তার নিজের অস্তিত্বের শব্দে বন্দি করে ফেলে। তাই হয়তো নীরবতার ঘরে ৪৫ মিনিটও টিকে থাকা যায় না। কারণ, সেখানে আমরা শুনে ফেলি সেই আওয়াজ, যা সারাজীবন আমাদের ভেতরে বাজছে, কিন্তু আমরা কখনও শোনার সাহস পাইনি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ