এক ফল, অসংখ্য উপকার : টক-মিষ্টি স্বাদে হজম ও হার্টের চমকপ্রদ উপকারিতা!

এক ফল, অসংখ্য উপকার : টক-মিষ্টি স্বাদে হজম ও হার্টের চমকপ্রদ উপকারিতা!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাঙালির রান্নাঘরে টক স্বাদের কথা উঠলে সবার আগে যে নামটি মনে আসে, তা হলো তেঁতুল। ভাতের সঙ্গে তেঁতুলের চাটনি, ডাল, মাছ বা আচার সব জায়গাতেই এর ব্যবহার বহুল। কিন্তু এই টক-মিষ্টি ফলটি কেবল স্বাদের জন্য নয়, আমাদের শরীরের ভেতরে একাধিক জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অবদান রাখে। হজম, হৃদযন্ত্র, লিভার, এমনকি রক্তে চিনি ও কোলেস্টেরলের ভারসাম্যেও এর ভূমিকা প্রমাণিত। চলুন, একবার দেখি তেঁতুলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই শক্তিগুলো।

তেঁতুলের পরিচয় ও পুষ্টিগত গঠন-

বৈজ্ঞানিক নাম Tamarindus indica। এটি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এক বৃক্ষ, যার ফলের গুদা অংশটিই আমরা খাই। শুকনো তেঁতুলের প্রতি ১০০ গ্রামে থাকে প্রায় ২৩৬ ক্যালরি, ৬২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ২.৮ গ্রাম প্রোটিন এবং প্রায় ৫.১ গ্রাম খাদ্য আঁশ।এ ছাড়াও তেঁতুলে থাকে- ভিটামিন সি, বি১, বি৩, ও বি৬,পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও ক্যালসিয়াম, এবং শক্তিশালী পলিফেনল ও ফ্ল্যাভোনয়েড নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান। এই উপাদানগুলোর সম্মিলিত প্রভাব শরীরের বহু অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

 

হজম প্রক্রিয়ায় তেঁতুলের ভূমিকা-

তেঁতুলের টক ভাবের মূল উৎস হলো টারটারিক অ্যাসিড, সাইট্রিক অ্যাসিড, ও ম্যালিক অ্যাসিড। এই প্রাকৃতিক অ্যাসিডগুলো পাকস্থলীর হজম এনজাইমগুলোর কার্যকারিতা বাড়ায়। 

◑ টারটারিক অ্যাসিড পাকস্থলীর অম্লমাত্রা ভারসাম্য বজায় রাখে।

◑ আঁশ (fiber) খাবার দ্রুত হজমে সাহায্য করে এবং অন্ত্রের চলাচল (bowel movement) স্বাভাবিক রাখে।

◑ পলিফেনল যৌগ পাকস্থলীর ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দমন করে ও অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর বৃদ্ধি বাড়ায়। ফলে তেঁতুলকে প্রাকৃতিক digestive stimulant বলা যায়।

 

হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায় -

তেঁতুলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, যেমন- ফ্ল্যাভোনয়েডস ও পলিফেনলস, রক্তে জমে থাকা ফ্রি র‍্যাডিকেল কমিয়ে হৃদপিণ্ডকে সুরক্ষিত রাখে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে- তেঁতুলে থাকা পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম রক্তনালীর প্রসারণ ঘটিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এতে থাকা polyphenolic compounds রক্তে LDL (খারাপ কোলেস্টেরল) কমিয়ে HDL (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়াতে সাহায্য করে। নিয়মিত সীমিত পরিমাণে তেঁতুল খেলে রক্তনালীর প্রদাহ কমে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। অর্থাৎ, তেঁতুল কেবল স্বাদে নয়, হৃদযন্ত্রের সুস্থতায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 

রক্তে চিনি ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা-

তেঁতুলের গুদা অংশে থাকা ট্যানিন ও আলকালয়েড জাতীয় যৌগ ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। এতে থাকা আঁশ রক্তে শর্করা দ্রুত বাড়তে দেয় না।
গবেষণায় দেখা গেছে, তেঁতুলের নির্যাস (tamarind extract) রক্তে গ্লুকোজের শোষণ প্রক্রিয়া ধীর করে, ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তবে এটি কখনোই চিকিৎসার বিকল্প নয়, বরং খাদ্যাভ্যাসের অংশ হিসেবে সহায়ক।

 

লিভার ও শরীর পরিশোধনে প্রাকৃতিক সহায়ক!

তেঁতুলকে প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রে 'ডিটক্স ফল' বলা হয়। এর কারণ এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও টারটারিক অ্যাসিড লিভার থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। এছাড়া, তেঁতুল রক্তের অম্ল–ক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখে, যার ফলে শরীরের মেটাবলিজম আরও সক্রিয় হয়। অনেকেই নিয়মিত তেঁতুল মেশানো পানি পান করেন লিভারের সুরক্ষার জন্য।

 

গরমে তেঁতুলের শরবত-

তেঁতুলের শরবত প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে 'প্রাকৃতিক কুল্যান্ট' হিসেবে ব্যবহৃত হতো। গ্রীষ্মে অতিরিক্ত ঘাম ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে শরীর থেকে ইলেকট্রোলাইট হারিয়ে যায়। তেঁতুলে থাকা পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও সামান্য সোডিয়াম সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। ফলে শরীরে ক্লান্তি কমে, মাংসপেশি ও স্নায়ু স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে।

 

ত্বক, প্রদাহ ও রোগ প্রতিরোধে উপকারীতা-

তেঁতুলের নির্যাসে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ আছে। এর ভিটামিন সি ত্বকের কোলাজেন গঠনে সাহায্য করে, ফলে ত্বক থাকে টানটান ও উজ্জ্বল। তেঁতুলের পেস্ট ত্বকের দাগ বা ট্যান দূর করতে ব্যবহৃত হয়। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ কোষের ক্ষয় রোধ করে, যা বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর করে দেয়।

 

সতর্কতা ও সীমাবদ্ধতা!

তেঁতুলে অ্যাসিডিক উপাদান বেশি থাকায় অতিরিক্ত খেলে পাকস্থলীর জ্বালাপোড়া, গ্যাস্ট্রিক বা দাঁতের এনামেল ক্ষয় হতে পারে। এছাড়া, রক্তচাপ কমানো ও রক্ত তরল রাখার প্রবণতার কারণে রক্তপাতজনিত সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের তেঁতুল খাওয়ার আগে সতর্ক থাকা উচিত।


তেঁতুল কেবল এক টক ফল ন, এটি প্রকৃতির এক বৈজ্ঞানিক বিস্ময়। স্বাদে অনন্য, আর গুণে ভরপুর। হজমে সহায়তা থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রের সুরক্ষা, লিভার পরিষ্কার, রক্তচাপ ও গ্লুকোজের ভারসাম্য, সব জায়গাতেই এর ভূমিকা রয়েছে। তাই তেঁতুলকে শুধু রান্নাঘরের মশলা নয়, বরং প্রাকৃতিক স্বাস্থ্যরক্ষক হিসেবে দেখা উচিত। পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত সেবনই হতে পারে শরীরের টক-মিষ্টি সমাধান।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ