কামরাঙার আত্মীয়, কিন্তু গুণে আলাদা!-বিলিম্বির স্বাস্থ্য ও ঔষধি গুণাবলী
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল বা উপকূলীয় অঞ্চলে একটি অচেনা হলেও অমূল্য ফলের দেখা মেলে,যার নাম বিলিম্বি (Bilimbi)। কামরাঙার মতোই দেখতে, তবে স্বাদে অনেক বেশি টক। এই সবুজ ফলটি শুধু রান্নায় নয়, বরং শরীরের পুষ্টি, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, এমনকি প্রাকৃতিক চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বিস্ময় জাগিয়েছে গবেষকদের।
বিলিম্বির বৈজ্ঞানিক নাম Averrhoa bilimbi। এটি কামরাঙা (Averrhoa carambola)–র একই গণভুক্ত।এর উৎপত্তি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উষ্ণ-আর্দ্র অঞ্চল, বিশেষ করে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন। পরবর্তীতে এটি ভারতের দক্ষিণাঞ্চল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, এমনকি আফ্রিকার কিছু অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে মূলত খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে বিলিম্বির গাছ বেশি দেখা যায়। এটি চিরসবুজ গাছ, উচ্চতা প্রায় ৫–১০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ফুল ও ফল ধরে সরাসরি কাণ্ডে বা পুরনো ডালের গায়ে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য একে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। ফলের গড় দৈর্ঘ্য ৫–৮ সেন্টিমিটার, পাতলা খোসা, ভিতরে নরম ও রসালো শাঁস।
বিলিম্বির ফলের প্রধান উপাদান হলো জৈব অ্যাসিড, যেমন:অক্সালিক অ্যাসিড, সাইট্রিক অ্যাসিড, টারটারিক অ্যাসিড- এই উপাদানগুলোই টক স্বাদের উৎস, যা প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণশীল গুণ রাখে (preservative nature)।ফল ছাড়াও এর পাতা ও ফুলেও রয়েছে জৈব সক্রিয় যৌগ, যেমন- ফ্ল্যাভোনয়েডস, পলিফেনল ও ট্যানিন, যেগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। প্রতি ১০০ গ্রাম বিলিম্বিতে থাকে গড়ে: ৪০–৫০ মি.গ্রা. ভিটামিন সি, ১০–১২ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ০.৩–০.৫ মি.গ্রা. আয়রন, ১০০–১৫০ মি.গ্রা. পটাশিয়াম, ১–২ গ্রাম ফাইবার, এবং মাত্র ৩০–৩৫ গ্রাম ক্যালোরি। এই ফলটি কম ক্যালোরিযুক্ত, কিন্তু ভরপুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে।
এতে থামা ভিটামিন সি শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় রাখে, কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে, ফলে ত্বক থাকে তরুণ।পটাশিয়াম, রক্তচাপ ও হার্টবিট নিয়ন্ত্রণে রাখে। আয়রন ও ক্যালসিয়াম, হাড় ও রক্তের জন্য কার্যকর। ডায়েটারি ফাইবার, হজম শক্তি বৃদ্ধি করে এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
বিলিম্বি অনেক সংস্কৃতিতে প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে-
☞ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লোকজ চিকিৎসা: পাতা ও ফলের রস ব্যবহার করা হয় ত্বকের চুলকানি, দাদ বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে।
☞ ফল সিদ্ধ করে পান করলে গলার ব্যথা, কাশি ও জ্বর কমাতে সাহায্য করে।
☞ পাতার নির্যাস প্রাকৃতিক ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে।
আধুনিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিলিম্বি নির্যাসে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েড ও ফেনলিক যৌগ শরীরের প্রদাহ (inflammation) কমাতে এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। এছাড়া এতে থাকা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড লিভারের কার্যক্রম সক্রিয় রাখে ও কোষের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, অতিরিক্ত বিলিম্বি খেলে উচ্চমাত্রার অক্সালিক অ্যাসিড কিডনিতে পাথর জমাতে পারে। তাই যারা কিডনি সমস্যা বা উচ্চ অ্যাসিড রিফ্লাক্সে ভোগেন, তাদের জন্য সীমিত পরিমাণে খাওয়াই ভালো।
বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে বিলিম্বি একটি জনপ্রিয় রান্নার উপাদান। বাংলাদেশে- চিংড়ি, ইলিশ বা শুঁটকি মাছের তরকারিতে বিলিম্বি দিলে খাবারে এক বিশেষ টক সুবাস আসে। শুকনো বিলিম্বি দিয়ে তৈরি হয় ঘন টক আচার, যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য। ঠান্ডা পানি, সামান্য লবণ ও চিনি মিশিয়ে বিলিম্বি জুস গরমের দিনে প্রাকৃতিক হাইড্রেটর হিসেবে কাজ করে।তাছাড়া, কাঁচা বিলিম্বি মিহি কেটে মরিচ-লবণ দিয়ে খেলে রসনা তৃপ্ত হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় এই ফল দিয়ে "asam belimbing" নামের এক বিশেষ তরকারি রান্না হয়, যার স্বাদ মশলাদার ও টক-মিষ্টি মিলিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয়।
বিলিম্বি গাছ তেমন যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে। এটি বেড়ে উঠার জন্য বেলে বা দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। গাছের শিকড় শক্ত, ফলে ঝড়বৃষ্টিতেও সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এটি এক প্রকার পরাগায়ন-বান্ধব গাছ, অর্থাৎ মৌমাছি, প্রজাপতি ইত্যাদি পরাগবাহী প্রাণীকে আকৃষ্ট করে। তাই এটি কেবল ফল নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও সহায়ক উদ্ভিদ।
প্রকৃতির এক অনন্য দান বিলিম্বি, যে ফল আমাদের চোখে অচেনা, অথচ গুণে ভরপুর। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো থেকে শুরু করে হৃদ্যন্ত্রের সুরক্ষা, ত্বকের উজ্জ্বলতা বা হজমের সহায়তা-সব দিক থেকেই এটি প্রকৃতির ছোট এক ল্যাবরেটরি। আজ যখন আমরা অর্গানিক ও প্রাকৃতিক খাবারের দিকে ঝুঁকছি, তখন বিলিম্বি হতে পারে এক চমৎকার বিকল্প।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।