যে মহাবিশ্বের গল্প এখনও কল্পনায়,JWST-এর আবিষ্কারে উন্মোচিত নতুন দিগন্ত!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
রাতের আকাশের দিকে তাকালে আমরা যে নক্ষত্রমালা, গ্যালাক্সি বা নীহারিকা দেখি, তার আলো আমাদের চোখে পৌঁছাতে হাজার হাজার কোটি বছর লেগে গেছে। অর্থাৎ, আমরা আসলে অতীত দেখছি! এই অতীতকেই সবচেয়ে কাছ থেকে দেখতে সক্ষম হয়েছে James Webb Space Telescope (JWST)- মানব ইতিহাসের সবচেয়ে উন্নত স্পেস টেলিস্কোপ, যা আমাদের চোখের সামনে খুলে দিচ্ছে মহাবিশ্বের প্রথম গ্যালাক্সিগুলোর জন্মের রহস্য।
JWST হলো নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ প্রকল্প। এটি ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং এখন অবস্থান করছে ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট ২ (L2)-এ, পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে। এর ৬.৫ মিটার প্রশস্ত সোনালি আয়না এবং ইনফ্রারেড সেন্সরগুলো এত সংবেদনশীল যে এটি এমন আলো শনাক্ত করতে পারে, যা ১৩.৫ বিলিয়ন বছর আগের। অর্থাৎ মহাবিশ্বের জন্মের কিছুদিন পরের সময়ের। এটি ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করে, যা ধূলিকণা ও গ্যাসমেঘের মধ্য দিয়েও আলো ধরতে পারে। ফলে অন্য কোনো টেলিস্কোপ যেখানে ব্যর্থ, জেমস ওয়েব সেখানে মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির ঝলক দেখাতে সক্ষম।
২০২৩ সালে জেমস ওয়েব শনাক্ত করেছে কয়েকটি অবিশ্বাস্য গ্যালাক্সি, যেমন GLASS-z13, CEERS-93316 ইত্যাদি, যেগুলো Big Bang-এর মাত্র ৩০০–৪০০ মিলিয়ন বছর পর গঠিত হয়েছিল।এর মানে, আমরা এখন এমন সময়ের আলো দেখছি, যখন মহাবিশ্বের বয়স ছিল মাত্র ৩% আজকের বয়সের সমান। এই গ্যালাক্সিগুলো আকারে ছোট, কিন্তু এতে রয়েছে অত্যন্ত উজ্জ্বল ও তরুণ নক্ষত্র, যা তখনকার মহাবিশ্বে প্রথম আলো জ্বালিয়েছিল।
বিজ্ঞানীরা একে বলেন "Cosmic Dawn"।
James Webb-এর ডেটা থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন যে, প্রথম নক্ষত্রগুলো ছিল Population III Stars, যেগুলোর গঠনে কোনো ভারী মৌল (যেমন লোহা, কার্বন, অক্সিজেন) ছিল না।তারা শুধু হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি হয়েছিল এবং ছিল সূর্যের চেয়ে শতগুণ ভারী ও লক্ষগুণ উজ্জ্বল।তাদের জীবনকাল ছিল খুবই স্বল্প, মাত্র কয়েক মিলিয়ন বছর। মৃত্যুর পর তারা সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মহাবিশ্বে প্রথম ভারী মৌলগুলো ছড়িয়ে দেয়।
এই মৌলগুলো দিয়েই পরবর্তীতে গঠিত হয় গ্রহ, পানি, এবং শেষ পর্যন্ত জীবন। অর্থাৎ, জেমস ওয়েব আমাদের দেখাচ্ছে সেই মুহূর্তগুলো, যখন জীবনের উপাদান প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বে তৈরি হচ্ছিল।
Big Bang-এর পর মহাবিশ্বে প্রথম কয়েকশো মিলিয়ন বছর ছিল এক অন্ধকার যুগ, Dark Ages।এই সময় পুরো মহাবিশ্ব ভরা ছিল নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন গ্যাসে, যা আলো শোষণ করত। প্রথম গ্যালাক্সি ও নক্ষত্র গঠনের পর তারা আলোকিত হয়ে সেই হাইড্রোজেনকে আয়নিত করতে শুরু করে, এই প্রক্রিয়াকেই বলে Cosmic Reionization।James Webb-এর পর্যবেক্ষণ এই সময়ের গঠন ও সময়কাল নিয়ে নতুন তথ্য দিচ্ছে, যা মহাবিশ্বের বিবর্তনের ধাপগুলো আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করছে।
বিজ্ঞানীদের অবাক করা তথ্য:
◑ কিছু গ্যালাক্সি এত বড় ও পরিণত অবস্থায় পাওয়া গেছে, যা তাত্ত্বিকভাবে তখন থাকা সম্ভব নয়। এটি বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে! সম্ভবত আমাদের বিগ ব্যাং-পরবর্তী সময়ের মডেলগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
◑ অনেক গ্যালাক্সির নক্ষত্রের ঘনত্ব ও উজ্জ্বলতা এত বেশি যে, হয়তো প্রথমদিকে মহাবিশ্বে নক্ষত্র গঠনের হার আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
◑ কিছু ক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে, তখনই হয়তো প্রথম ব্ল্যাক হোলগুলোর জন্ম হয়েছিল, যারা আজকের বিশাল গ্যালাক্সিগুলোর কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
জেমস ওয়েব আমাদের শুধু দূর মহাবিশ্বের ছবি দিচ্ছে না এটি আমাদের শেখাচ্ছে, কোথা থেকে আমরা এসেছি, কীভাবে আমাদের গ্রহ ও জীবন তৈরি হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে মহাবিশ্ব কোথায় যাবে। এই পর্যবেক্ষণগুলো মহাবিশ্বের গঠন, সময়ের ধারণা, এবং পদার্থের বিবর্তন সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করছে বিজ্ঞানীদের। এটি মানবজ্ঞানকে এক নতুন মহাকাশযুগে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এখন আর কল্পনা নয়, বরং বাস্তব বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান।
James Webb Telescope আমাদের জানাচ্ছে, মহাবিশ্ব এখনো তার গোপন অধ্যায়গুলো খুলে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। যে আলো আজ আমাদের চোখে পৌঁছেছে, তা কোনো এক গ্যালাক্সির প্রাচীন অস্তিত্বের নিঃশ্বাস।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।