দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ফুল!- Corpse Flower-এর রহস্য যা আপনাকে হতবাক করবে

দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ফুল!- Corpse Flower-এর রহস্য যা আপনাকে হতবাক করবে
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

প্রকৃতির রাজ্যে এমন অনেক ফুল আছে, যেগুলোর সৌন্দর্য ও সুবাস মানুষকে মুগ্ধ করে। কিন্তু একটি ফুল আছে, যার গন্ধ শুনলেই বেশিরভাগ মানুষ নাক চেপে ধরেন। নাম তার 'Corpse Flower' বা লাশফুল। এই ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Amorphophallus titanum, যা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ফুল হিসেবে পরিচিত। তার বিরলতা, বিশাল আকার এবং ভয়ানক গন্ধ মিলে এটি আজ প্রকৃতির এক বিস্ময়কর রহস্যে পরিণত হয়েছে।

কোথায় পাওয়া যায় এই অদ্ভুত ফুল?

Corpse Flower মূলত ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের ট্রপিকাল রেইনফরেস্টে স্বাভাবিকভাবে জন্মায়। এটি এমন একটি পরিবেশে বেড়ে ওঠে যেখানে প্রচণ্ড আর্দ্রতা, উষ্ণ তাপমাত্রা ও ঘন বন রয়েছে। আজকাল এটি বিশ্বজুড়ে অনেক বোটানিক্যাল গার্ডেনে (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপের কিছু দেশে) সংরক্ষিত অবস্থায় দেখা যায়, কারণ বন্য পরিবেশে এদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।

এই ফুলের আকার ও গঠন সত্যিই বিস্ময়কর। ফুলটি সম্পূর্ণ ফুটলে এর উচ্চতা ৩ মিটার পর্যন্ত হতে পারে, আর একে ঘিরে থাকা পাতার বিস্তার প্রায় ১.৫ মিটার। ফুলটি দেখতে অনেকটা বিশালাকার কলার মতো, বাইরের দিক গাঢ় বেগুনি এবং ভেতরের দিক সবুজাভ হলুদ। এটি আসলে একটি একক ফুল নয় বরং অসংখ্য ছোট ফুল একত্রে মিলে তৈরি একটি ইনফ্লোরেসেন্স (inflorescence)। অর্থাৎ একগুচ্ছ ক্ষুদ্র ফুল একসাথে ফুটে একটি বিশাল দেহ ধারণ করে।

Corpse Flower ফুটলে তার গন্ধ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে কয়েকশো মিটার পর্যন্ত। এই গন্ধ পচা মাংস বা মৃত প্রাণীর মতো দুর্গন্ধযুক্ত। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ফুলটি থেকে নির্গত হয় এমন রাসায়নিক যৌগ- Dimethyl trisulfide, Dimethyl disulfide, Trimethylamine, যেগুলো মৃতদেহ পচনের সময় উৎপন্ন হয়। ফলে আশপাশের মানুষই নয়, প্রাণীরাও অনেক দূর থেকে গন্ধ টের পায়।
 

কিন্তু এই দুর্গন্ধেরও কাজ আছে!

অদ্ভুত হলেও সত্যি, এই ভয়ংকর গন্ধের কারণেই ফুলটি টিকে আছে। প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্ত বেঁচে থাকার কৌশল। Corpse Flower এই গন্ধ ছড়িয়ে পচা মাংসপ্রেমী পোকামাকড় (যেমন বিটল, মাছি ইত্যাদি) আকর্ষণ করে। এই পোকামাকড় ফুলের ভিতরে ঢুকে পরাগায়নের (pollination) কাজ করে। অর্থাৎ, গন্ধ যতই দুর্গন্ধযুক্ত হোক, এটি ফুলটির প্রজননের একমাত্র উপায়।
 

ফুল ফোটার রহস্য- 

Corpse Flower গাছটি সাধারণত ৭–১০ বছর বয়সে প্রথম ফুল ফোটায়, এবং তার পর আবার ফুল ফোটাতে আরও কয়েক বছর সময় নেয়।
সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, ফুলটি মাত্র ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত ফোটে, তারপর মলিন হয়ে যায়।ফুল ফোটার সময় এর ভিতরের তাপমাত্রা প্রায় ৩৭°C পর্যন্ত বেড়ে যায়, যা মানুষের শরীরের তাপমাত্রার সমান।এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ফুলের গন্ধ আরও দূরে ছড়িয়ে পড়ে, ফলে পোকামাকড় সহজে আকৃষ্ট হয়।
 

জীবনচক্র- 

Corpse Flower মূলত একটি বিশালাকার Corm (গুটি আকৃতির কন্দ) থেকে জন্মায়, যার ওজন ৫০–৭০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। একটি ফুল ঝরে যাওয়ার পর এটি আবার পাতা তৈরি করে, যেগুলো দেখতে ছোট গাছের মতো। সেই পাতাগুলো সূর্যালোক থেকে খাদ্য তৈরি করে কন্দে জমা রাখে, যা ভবিষ্যতের ফুল ফোটার শক্তি জোগায়।

 

কেন বিপন্ন হচ্ছে এই ফুল? 

ইন্দোনেশিয়ার বনাঞ্চলে অতিরিক্ত বন উজাড়, কৃষিজমি সম্প্রসারণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে Corpse Flower ক্রমেই বিলুপ্তির পথে। IUCN (International Union for Conservation of Nature) এই ফুলটিকে "Vulnerable Species" হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে উদ্ভিদবিদরা সংরক্ষিতভাবে এর চাষ করছেন, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মও এই বিস্ময়কর ফুলটি দেখতে পারে।

গবেষকরা মনে করেন, Corpse Flower প্রকৃতির এক অসাধারণ উদাহরণ, যেখানে সৌন্দর্যের পরিবর্তে বিবর্তনের বুদ্ধিমত্তাই মুখ্য। এটি দেখায় যে, প্রকৃতি শুধু রূপ নয়, কৌশল ও অভিযোজনের মধ্যেও কতটা সৃজনশীল। ড. ম্যাথিউ ফ্রিডম্যান, শিকাগো বোটানিক গার্ডেনের এক উদ্ভিদবিশারদ  বলেন, "Corpse Flower আমাদের শেখায় যে, প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টি কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে তৈরি। এমনকি দুর্গন্ধও কখনো জীবন বাঁচানোর উপায় হতে পারে।"

Corpse Flower হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ফুল, কিন্তু তার অদ্ভুত জীবনচক্র, বিশালতা ও বেঁচে থাকার বুদ্ধি একে প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি বানিয়েছে। যেখানে মানুষ সৌন্দর্যে খুঁজে নেয় আকর্ষণ, সেখানে এই ফুল প্রমাণ করে- প্রকৃতির সৌন্দর্য শুধু চোখে নয়,  রহস্যেও লুকিয়ে থাকে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ