ডিপ্রেশনে ওষুধ নয়, উপন্যাস!-বিজ্ঞানীরা জানালেন নতুন 'লিটারেচার থেরাপি' রহস্য
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
অবসাদ বা ডিপ্রেশন শুধু মনের দুঃখ নয়, এটি মূলত মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যের এক সূক্ষ্ম বিপর্যয়। নিঃশব্দে ঘটে যাওয়া এই মানসিক ব্যাধি প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। চিকিৎসকরা যেমন ওষুধ ও থেরাপির মাধ্যমে নিরাময়ের চেষ্টা করেন, তেমনি মনোবিজ্ঞানীরা এখন নতুন এক দিক দেখছেন, সাহিত্যপাঠকে মানসিক আরোগ্যের সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে।
অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় মস্তিষ্কে সেরোটোনিন, ডোপামিন ও নরএড্রেনালিন নামের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা কমে যায়। এগুলোই মূলত আমাদের সুখ, প্রেরণা ও মনোযোগের নিয়ন্ত্রক। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে মানুষ আনন্দ অনুভব করতে পারে না, চিন্তার গতি ধীর হয়ে যায়, জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলে।
নিউরোসায়েন্টিস্টদের মতে, অবসাদের সময় প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স( যুক্তিবোধের কেন্দ্র) ও অ্যামিগডালা (আবেগের নিয়ন্ত্রণ করে) — এই দুটি অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ অতীতের কষ্টে ডুবে থাকে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা হারায়। এই সময় সাহিত্য ঠিক সেখানেই এক ধরনের মানসিক 'সেতুবন্ধন' তৈরি করতে পারে।
মনোবিজ্ঞানে এই ধারণাকে বলা হয় বিবলিওথেরাপি (Bibliotherapy), অর্থাৎ সাহিত্যভিত্তিক মানসিক নিরাময় পদ্ধতি। এখানে বই, গল্প, কবিতা, বা জীবনী পাঠের মাধ্যমে ব্যক্তির অনুভূতি ও চিন্তার ধরণে পরিবর্তন আনা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সাহিত্যপাঠে mirror neuron system সক্রিয় হয় অর্থাৎ, আমরা যখন কোনো চরিত্রের কষ্ট বা আনন্দ পড়ি, তখন মস্তিষ্ক যেন নিজেই তা অনুভব করে। এর ফলেই জন্ম নেয় সহানুভূতি, আত্ম-চেতনা ও মানসিক উন্মোচন। এই প্রক্রিয়া অনেকটা থেরাপি সেশনের মতো কাজ করে, যেখানে পাঠক নিজের অনুভূতিগুলোকে চিনে নিতে শেখে, মেনে নিতে শেখে, আর ধীরে ধীরে নিজের কষ্টের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
সাহিত্য কীভাবে মস্তিষ্কে কাজ করে?
১. আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে: সাহিত্যপাঠে অ্যামিগডালার উত্তেজনা কমে, ফলে ভয় ও দুঃখের প্রবণতা হ্রাস পায়।
২. মনোযোগ বাড়ায়: পড়ার সময় 'ডিফল্ট মোড নেটওয়ার্ক' সক্রিয় হয়, যা মনোযোগ, বিশ্লেষণ ও আবেগের ভারসাম্য রক্ষা করে।
৩. স্মৃতিশক্তি উন্নত করে: গল্পের কাহিনি, চরিত্র ও ভাষার গঠন মনে রাখতে গিয়ে মস্তিষ্কে নতুন সিন্যাপটিক সংযোগ তৈরি হয়।
৪. ডোপামিন নিঃসরণ ঘটায়: পাঠের আনন্দ, চিন্তার তৃপ্তি ও সহানুভূতির মুহূর্তগুলো মস্তিষ্কে 'রিওয়ার্ড সার্কিট' সক্রিয় করে, যা সুখানুভূতি জাগায়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে — নিয়মিত সাহিত্যপাঠে অবসাদের লক্ষণ ৩০–৪০% পর্যন্ত কমে যায়, বিশেষ করে যখন পাঠক নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে গল্পের সংযোগ খুঁজে পায়।মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সাহিত্য মানুষকে নিজের আবেগ চিনতে শেখায়, যা অনেক সময় ওষুধের চেয়েও কার্যকরভাবে মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। তারা আরও উল্লেখ করেন, গল্পের চরিত্রদের যাত্রা বা সংগ্রাম পাঠককে আত্মপর্যালোচনায় উৎসাহিত করে, যা থেরাপির অন্যতম উদ্দেশ্য। সাহিত্য পাঠ এক অর্থে নিজের জীবনের আয়না দেখা, তবে ব্যথাহীনভাবে।
যখন মানুষ পড়ার মাধ্যমে অন্য কারও অভিজ্ঞতা অনুভব করে, তখন মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে শিখে- সব কষ্টই চিরস্থায়ী নয়। উদাহরণস্বরূপ, উপন্যাসের কোনো চরিত্র যদি হেরে গিয়েও জীবনকে নতুনভাবে শুরু করে, পাঠক সেখানে নিজেকে দেখতে পায়। এতে অবচেতনভাবে জাগে নতুন প্রেরণা ও আশাবাদ। এই কারণেই অনেক মনোবিজ্ঞানী অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বলেন,"প্রতিদিন অন্তত কিছুক্ষণ এমন কিছু পড়ো, যা তোমার ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলবে।"
কোন সাহিত্য কার্যকর হতে পারে?
◑ কবিতা: আবেগের গভীরে পৌঁছে যায়; মনের চাপ হালকা করে।
◑ উপন্যাস বা ছোটগল্প: বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে আত্ম-পরিচয়ের পথ খোঁজায় সাহায্য করে।
◑ জীবনী বা আত্মজীবনী: সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প মানুষকে দৃঢ় করে তোলে।
◑ দার্শনিক লেখা: জীবনের অর্থ ও মূল্যবোধ নিয়ে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়।
তবে গবেষকরা পরামর্শ দেন, অবসাদের প্রাথমিক পর্যায়ে খুব ভারী বা দুঃখঘন সাহিত্য এড়িয়ে হালকা, আশাবাদী লেখা পড়া উচিত।
দিনে মাত্র ১৫–৩০ মিনিট বই পড়া মস্তিষ্কে প্রশান্তি আনে, হার্টরেট কমায়, ঘুমের মান উন্নত করে।বিশেষত ঘুমানোর আগে কিছু পড়া 'রুমিনেশন' (অতীত ভাবনায় ডুবে থাকা) কমিয়ে মস্তিষ্ককে শান্ত করে। যেমন: রাতে এক কাপ চা হাতে ছোট গল্প বা কবিতা পড়া, কিংবা সকালে সূর্যের আলোয় পছন্দের প্রবন্ধে ডুবে থাকা-এই ক্ষুদ্র অভ্যাসগুলো ধীরে ধীরে মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনে।
সাহিত্য মানুষকে শেখায় ভাঙা মানেই শেষ নয়, বরং পুনর্গঠনের শুরু। একেকটি গল্প বা কবিতা যেন মনের ঘরে নতুন জানালা খুলে দেয়। যে পাঠক একসময় নিজের ভেতরের অন্ধকারে আটকে ছিল, সে গল্পের আলোয় খুঁজে পায় মুক্তি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, এটিই হলো "narrative healing", অর্থাৎ গল্পের মাধ্যমে আত্ম-নিরাময়।
অবসাদগ্রস্ত মস্তিষ্কে সাহিত্য যেন এক নিরব, অথচ কার্যকর ওষুধ। এটি মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য পুনর্গঠনে সাহায্য করে, আবেগকে নরম করে, চিন্তার জট ছাড়ায়।থেরাপি, ওষুধ বা মেডিটেশনের পাশাপাশি সাহিত্য হতে পারে সেই অদৃশ্য সেতু, যা মানুষকে আবার জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে। একটি ভালো বই হাতে নেওয়া মানেই শুধু গল্পে হারিয়ে যাওয়া নয় এটি নিজের ভেতরের হারিয়ে যাওয়া অংশটিকে ধীরে ধীরে খুঁজে পাওয়া।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।