অদ্ভুত ভাষায় লেখা বই, যেটার ভাষা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি-'Voynich Manuscript'-এর রহস্য!

অদ্ভুত ভাষায় লেখা বই, যেটার ভাষা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি-'Voynich Manuscript'-এর রহস্য!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বিশ্বের গ্রন্থ ইতিহাসে এমন একটি বই আছে, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানী, ভাষাবিদ, ক্রিপ্টোগ্রাফার ও ইতিহাসবিদদের বিভ্রান্ত করে রেখেছে। বইটি Voynich Manuscript এক রহস্যময় হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি, যার ভাষা, লিপি, এমনকি লেখার উদ্দেশ্যও আজ পর্যন্ত কেউ নির্ভুলভাবে বুঝতে পারেনি। বলা হয়, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় বই, যার প্রতিটি পৃষ্ঠা এক নতুন ধাঁধা, প্রতিটি চিত্র যেন এক গোপন বার্তা।

বইটি কোথা থেকে এলো?

'Voynich Manuscript'-এর নামকরণ হয়েছে Wilfrid M. Voynich নামে এক পোলিশ বই সংগ্রাহকের নামে, যিনি ১৯১২ সালে ইতালির এক প্রাচীন মঠ থেকে বইটি সংগ্রহ করেন। তবে এর উৎপত্তি তার অনেক আগেই। রেডিওকার্বন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বইটির পার্চমেন্ট (চর্মপত্র) তৈরি হয়েছিল ১৪০৪ থেকে ১৪৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, অর্থাৎ মধ্যযুগের প্রথম দিকে। কিন্তু কে লিখেছিলেন এই বইটি? কোন ভাষায়? আর কেনই বা লিখেছিলেন?—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজও অজানা।

 

ভিতরের চিত্র ও লেখার ধরন:

বইটিতে আছে প্রায় ২৪০টি পৃষ্ঠা, আর প্রতিটি পৃষ্ঠা ভরা অদ্ভুত অক্ষর, জটিল প্রতীক ও অচেনা চিত্রে। এতে দেখা যায় অজানা গাছপালা, যেগুলো কোনো পরিচিত প্রজাতির সঙ্গে মেলে না। রয়েছে রহস্যময় নারীচিত্র, যারা কোনো তরল পদার্থে স্নান করছে বা নলাকার কাঠামোতে সংযুক্ত, যা জীববিজ্ঞানের কোনো অদ্ভুত ইঙ্গিত মনে হয়। অনেক পৃষ্ঠায় আঁকা রয়েছে গোলাকার চিত্র, নক্ষত্রমণ্ডল ও চাঁদ-সূর্যের প্রতীক, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। লেখাটি এমন এক লিপিতে লেখা, যা পৃথিবীর কোনো পরিচিত ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ২০-২৫টি অক্ষর, এবং পুরো বই জুড়ে শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি দেখা যায়, যেন কোনো বিশেষ গোপন প্যাটার্ন অনুসরণ করছে।

 

 

ডিকোড করার শত বছরের চেষ্টা:

'Voynich Manuscript' প্রকাশের পর থেকেই এর রহস্য ভাঙার চেষ্টা চলছে। প্রথমে অনেকে ভাবেন এটি কোনো গোপন রাসায়নিক বা চিকিৎসা সূত্র।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্রিপ্টোগ্রাফাররা, যারা নাৎসি কোড ভাঙতে পারতেন, তারাও এই পাণ্ডুলিপি বিশ্লেষণ করে এর ভাষা ভাঙতে পারেননি।
কেউ কেউ বলেন, এটি হয়তো আলকেমির (alchemy) গোপন জ্ঞান ধারণ করছে। আবার অনেকে মনে করেন এটি কোনো অজানা বা কৃত্রিম ভাষায় লেখা, যার বর্ণমালা মানুষই তৈরি করেছে কিন্তু সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে। তবে বহু গবেষণা ও ডিজিটাল বিশ্লেষণেও বইটির ভাষার ধরণ, ব্যাকরণ ও শব্দ বিন্যাসে এমন কিছু প্যাটার্ন পাওয়া গেছে যা প্রকৃত ভাষার মতোই। অর্থাৎ এটি কোনো এলোমেলো প্রতারণা নয়, বরং কোনো এক বাস্তব বা সুনির্দিষ্ট যুক্তি অনুসারে লেখা।

 

আধুনিক বিশ্লেষণ ও এআই-এর ভূমিকা:

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে Artificial Intelligence (AI) ব্যবহার করে এই রহস্য বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।AI মডেলগুলো এই লেখাকে প্রাচীন ইউরোপীয় ভাষাগুলোর সঙ্গে তুলনা করে দেখেছে, এবং কিছু বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, এতে হয়তো ধর্মীয় বা চিকিৎসাবিষয়ক তথ্য লুকানো আছে।কিছু গবেষক ধারণা করেন, এটি হয়তো প্রাচীন কোনো নারী-চিকিৎসা বই, যেখানে মহিলাদের শারীরবৃত্তীয় বিষয় ও ভেষজ চিকিৎসার গোপন জ্ঞান সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই জ্ঞান হারিয়ে যায়।তবে এখনো কোনো মেশিন বা মানুষ নিশ্চিতভাবে বলতে পারেনি, এই লেখার অর্থ কী। AI শুধু বলছে- লেখাটি যথেষ্ট জটিল, কিন্তু তাতে এমন কিছু পুনরাবৃত্ত প্যাটার্ন আছে যা এক জীবন্ত ভাষার মতোই আচরণ করে।

একদল গবেষক মনে করেন, এটি এক চমৎকার প্রতারণা-একজন মধ্যযুগীয় কৌতুকপ্রিয় লেখক হয়তো বইটি লিখেছিলেন শুধু পণ্ডিতদের বিভ্রান্ত করার জন্য।অন্যদিকে, ইতিহাসবিদদের আরেক অংশের মতে, এটি হতে পারে হারানো কোনো সভ্যতার ভাষা, যার কোনো রেকর্ড আজ আর অবশিষ্ট নেই।

তবে বইটির লেখার নিয়ম, ধারা, ও চিত্রের সূক্ষ্মতা দেখে বেশিরভাগ গবেষকই একমত- এটি কোনো অর্থহীন প্রতারণা নয়। বরং এক গভীর জ্ঞানভিত্তিক রচনা, যার অর্থ বোঝার চাবিটি আমরা এখনো খুঁজে পাইনি।

 

এখন বইটি কোথায়? 

বর্তমানে এই রহস্যময় পাণ্ডুলিপিটি যুক্তরাষ্ট্রের Yale University-এর Beinecke Rare Book & Manuscript Library-এ সংরক্ষিত আছে। এটি বিশেষ তাপমাত্রায় রাখা হয় যাতে পার্চমেন্টের ক্ষয় না হয়। প্রতি বছর হাজার হাজার গবেষক ও ভাষাবিদ বইটি দেখতে আসেন এবং প্রত্যেকে ফিরে যান নতুন কৌতূহল নিয়ে, কারণ এই বই যেন প্রতিবারই নতুনভাবে প্রশ্ন তোলে, উত্তর দেয় না।

 

'Voynich Manuscript' আজও মানুষের কাছে এক অমীমাংসিত রহস্য।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তি যত উন্নতই হোক,  মানুষের কৌতূহল ও অজানার আকর্ষণ এখনও সীমাহীন। একটি বই, যেটি ৬০০ বছর ধরে মানব মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যাচ্ছে, আজও যেন নীরবে বলে, সব জ্ঞানই উন্মোচিত হয়নি, কিছু রহস্য রয়ে গেছে সময়ের পাণ্ডুলিপিতে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ