মস্তিষ্ককে শান দিন! বুদ্ধির কারিগরিতে বাড়ান স্মৃতিশক্তি ও সজীবতা
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আমাদের মস্তিষ্ক একটানা কাজ করে চলেছে জন্মের আগে থেকেই। প্রতিদিন চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক- এই পাঁচ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অসংখ্য তথ্য এতে জমা হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, মানবমস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা প্রায় ২.৫ পেটাবাইট, অর্থাৎ এক মিলিয়ন গিগাবাইটের মতো তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব! এই বিশাল ডেটা ভাণ্ডার শুধু তথ্য রাখার কাজই করে না, বরং শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রমও নিরবচ্ছিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এই ধারাবাহিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে গিয়ে মস্তিষ্কও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোষের কার্যকারিতা কমে যায়, স্মৃতি দুর্বল হয়, মনোযোগ বিচ্যুত হয়।
বিজ্ঞান বলছে, সাধারণত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত মস্তিষ্ক তার সর্বোচ্চ কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারে, এরপর ধীরে ধীরে স্মৃতি ও মনোযোগের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে। কিন্তু সুখবর হলো- মস্তিষ্কও শরীরের অন্য অঙ্গের মতোই চর্চা ও যত্নে তীক্ষ্ণ ও সক্রিয় রাখা যায়। নিচে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও অভ্যাসের কথা তুলে ধরা হলো, যা নিয়মিত অনুশীলনে মস্তিষ্ককে রাখবে তরতাজা ও কর্মক্ষম-
১. শব্দ করে পড়ার অভ্যাস করা, এতে দ্বিগুণভাবে স্মৃতি সক্রিয় হয়! পড়া মানে কেবল চোখ দিয়ে লেখা দেখা নয়, শ্রবণও এখানে বড় ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, জোরে শব্দ করে পড়লে মস্তিষ্কের শ্রবণ ও দৃষ্টিগ্রাহ্য দুই অংশই সক্রিয় হয়, ফলে তথ্য দীর্ঘসময় মনে থাকে। ২০১১ সালে কানাডার একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা পড়ার সময় উচ্চারণ করে বা অডিও শোনে, তারা ৭৭% বেশি সময় পর্যন্ত তথ্য মনে রাখতে পারে। অর্থাৎ, পড়ার সঙ্গে শোনার অভ্যাস স্মৃতিশক্তিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায়। শিশুদের পড়ানোর সময় যেমন শিক্ষকরা উচ্চারণ করে পড়তে বলেন, তেমনি বড়দের ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর।প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও নিয়মিত জোরে পড়া বা অডিওবুক শোনার অভ্যাস মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসকে সক্রিয় রাখে।
২. একই পথে না গিয়ে নতুন রাস্তা বেছে নিন। একই রুটে প্রতিদিন অফিস, স্কুল বা বাজারে যাতায়াত করলে আমাদের মস্তিষ্ক অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে অটোমেটিক মোডে কাজ করে। কিন্তু সপ্তাহে এক-দুদিন ভিন্ন পথে যাওয়া মস্তিষ্ককে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে, যা নিউরনগুলোর মধ্যে নতুন সংযোগ তৈরি করে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন "neuroplasticity", অর্থাৎ, নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তনের ক্ষমতা। একই কাজের পুনরাবৃত্তি মস্তিষ্ককে অলস করে ফেলে, কিন্তু নতুন পদ্ধতি মস্তিষ্কের প্রসেসিং ক্ষমতা বাড়ায় এবং মনোযোগ শানিত করে।
৩. নতুন মানুষের সঙ্গে মেশা: চিন্তার পরিধি প্রসারিত করে। নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় মানে নতুন ভাবনা, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের মস্তিষ্ক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শেখে, চিন্তা করে ও যুক্তি গড়ে। তাই একই পরিসরে সীমাবদ্ধ না থেকে ভিন্ন পেশা বা আগ্রহের মানুষের সঙ্গে আলাপ করলে মস্তিষ্কে নতুন তথ্য প্রবেশ করে। এই মানসিক উদ্দীপনা "ডোপামিন" নামের এক ধরনের নিউরোকেমিক্যাল নিঃসরণ ঘটায়, যা শেখার আগ্রহ বাড়ায় এবং মুড উন্নত রাখে।
৪. প্রতিদিন অন্তত একটি শখের কাজ করুন। বাগান করা, বই পড়া, সংগীত শোনা, চিত্রাঙ্কন—যে কাজই মনকে শান্তি দেয়, সেটি নিয়মিত চর্চা করলে মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও এন্ডরফিন হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে। এই রাসায়নিকগুলো চিন্তা ও চাপ কমায়, সৃজনশীলতা বাড়ায়। শখের কাজ একদিকে বিশ্রাম দেয়, অন্যদিকে অবচেতনে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলকে সক্রিয় রাখে। এতে মানসিক স্থিতি আসে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও বাড়ে।
৫. ধাঁধা, সুডোকু ও মস্তিষ্কচর্চার গেম! ধাঁধা বা সুডোকু খেললে মস্তিষ্কে বিশ্লেষণী ও যৌক্তিক চিন্তার অংশগুলো (বিশেষ করে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স) সক্রিয় হয়। প্রতিদিন অন্তত কিছু সময় ব্রেইন ট্রেনিং গেম খেললে নিউরনগুলোর সংযোগ দৃঢ় হয় এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণের গতি বাড়ে। বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, নিয়মিত ধাঁধা বা লজিক-ভিত্তিক খেলা খেললে আলঝেইমার বা স্মৃতিভ্রংশের ঝুঁকি ৩০% পর্যন্ত কমানো যায়।
৬. পর্যাপ্ত ঘুম ও পানি গ্রহণ করুন। ঘুমের সময় মস্তিষ্ক দিনভর জমে থাকা তথ্য সাজিয়ে নেয় এবং অপ্রয়োজনীয় তথ্য মুছে ফেলে। তাই প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম অপরিহার্য। এছাড়া পর্যাপ্ত পানি পান মস্তিষ্কের কোষে অক্সিজেন প্রবাহ ঠিক রাখে, যা মনোযোগ ও মুড নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
৭. নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন। শরীরচর্চা কেবল পেশী নয়, মস্তিষ্ককেও সক্রিয় রাখে। শারীরিক পরিশ্রমে রক্তপ্রবাহ বাড়ে, ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ উন্নত হয়। একই সঙ্গে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, বাদাম, ডিম, সবুজ শাকসবজি ও ফল মস্তিষ্কের নিউরনকে পুষ্টি দেয়।
মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ানোর কোনো জাদু নেই, আছে নিয়মিত চর্চা, নতুন অভিজ্ঞতা, বিশ্রাম ও সঠিক জীবনযাপন। পড়া, কথা বলা, ভ্রমণ, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, শখ, খেলা-এসবই মস্তিষ্কের জন্য "জিমের ব্যায়াম"।যত বেশি আপনি চিন্তা করবেন, শেখার চেষ্টা করবেন, ততই আপনার মস্তিষ্ক শানিত, তরতাজা ও সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।