ডায়েট নয়, আতঙ্ক: ইটিং ডিজঅর্ডার এবং তার স্বাস্থ্যঝুঁকির গল্প!

ডায়েট নয়, আতঙ্ক: ইটিং ডিজঅর্ডার এবং তার স্বাস্থ্যঝুঁকির গল্প!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আজকের দ্রুতগামী পৃথিবীতে খাবার আর কেবল ক্ষুধা মেটানোর উপায় নয়, বরং জীবনধারা, সৌন্দর্যচর্চা ও মানসিক অবস্থার প্রতিফলন হয়ে উঠেছে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে খাবারের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে, যা জন্ম দেয় ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা ইটিং ডিজঅর্ডার (Eating Disorders)। এটি শুধু খাদ্যাভ্যাসের গোলযোগ নয়, বরং জটিল মানসিক ব্যাধি, যা শারীরিক স্বাস্থ্যকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কখনো কখনো মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে।

ইটিং ডিজঅর্ডারের প্রধান ধরণ:

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ইটিং ডিজঅর্ডারের তিনটি প্রধান রূপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়—

১। অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা (Anorexia Nervosa): ওজন বেড়ে যাওয়ার ভয় রোগীকে খাবার এড়িয়ে চলতে বাধ্য করে। শরীরে পুষ্টির ঘাটতি, অতি দুর্বলতা, হাড় ক্ষয়, মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং হৃদ্‌যন্ত্রের জটিলতা দেখা দেয়।

মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি এই ধরনের রোগীর মধ্যে।
 

২। বুলিমিয়া নার্ভোসা (Bulimia Nervosa): রোগী হঠাৎ অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতায় আক্রান্ত হয়, এরপর ক্যালোরি কমানোর জন্য খাবার বমি করে বের করে দেয় বা অতিরিক্ত ব্যায়াম করে।এর ফলে দাঁতের ক্ষয়, খাদ্যনালীতে ক্ষত, শরীরের পানিশূন্যতা, হৃদস্পন্দনের সমস্যা দেখা দেয়।

 

 

৩। বিঞ্জ ইটিং ডিজঅর্ডার (Binge Eating Disorder): নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রচুর খাবার খাওয়া হয়, তবে পরবর্তীতে প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভোগে।স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

 

 

কেন ঘটে এই মানসিক ব্যাধি?

ইটিং ডিজঅর্ডারের মূল কারণ বহুমাত্রিক-

⇨ মানসিক চাপ ও ট্রমা: পরিবারে অবহেলা, নির্যাতন বা মানসিক আঘাত খাওয়ার ধরনকে অস্বাভাবিক করে তোলে।

⇨ সামাজিক সৌন্দর্যের চাপ: চিকন বা ছিপছিপে শরীরকে সৌন্দর্যের মানদণ্ড মনে করা, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব তরুণদের ঝুঁকিতে ফেলে।

⇨ জেনেটিক কারণ: পরিবারে কেউ এই ব্যাধিতে ভুগলে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

⇨ হরমোন ও মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্য: ডোপামিন ও সেরোটোনিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার ভারসাম্যহীন হলে খাওয়ার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হতে পারে।

 

শারীরিক ও মানসিক জটিলতা:

ইটিং ডিজঅর্ডারকে হালকা করে দেখলে চলবে না। এটি কেবল ওজনের ওঠানামার বিষয় নয়, বরং পুরো শরীরকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়।

⇨ পুষ্টিহীনতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস

⇨ হাড় ক্ষয় ও অকাল বার্ধক্য

⇨ হরমোনের অসামঞ্জস্য

⇨ হৃদ্‌যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা

⇨ দীর্ঘমেয়াদে বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং আত্মহত্যার 

⇨ প্রবণতা
 

চিকিৎসা ও সমাধান

বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন-ইটিং ডিজঅর্ডার শুধুমাত্র খাবারের সমস্যা নয়, এটি মানসিক স্বাস্থ্য সংকট। তাই চিকিৎসায় একাধিক ধাপ প্রয়োজন—

⇨ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও থেরাপি: কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) রোগীকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করে।

⇨ পুষ্টি ব্যবস্থাপনা: ধীরে ধীরে সুষম খাদ্যাভ্যাসে ফিরিয়ে আনার জন্য পুষ্টিবিদের পরামর্শ অপরিহার্য।

⇨ ওষুধ: উদ্বেগ ও বিষণ্নতা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

⇨ পরিবারের ভূমিকা: রোগীকে দোষারোপ না করে সহমর্মিতা ও সহায়তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি।
 

বাংলাদেশে ইটিং ডিজঅর্ডার নিয়ে সচেতনতা এখনো সীমিত। অধিকাংশ মানুষ এই সমস্যাকে কেবল "খাওয়ার খুঁতখুঁতে অভ্যাস" হিসেবে দেখে। তবে শহুরে তরুণদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ, শরীরচর্চা নিয়ে অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা এবং সৌন্দর্যের ভুল ধারণার কারণে সমস্যা বাড়ছে।গবেষণা বলছে, ঢাকাসহ বড় শহরে কিশোরী ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীদের মধ্যে এই প্রবণতা তুলনামূলক বেশি।

সচেতনতার অভাব ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক ট্যাবু থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীরা চিকিৎসা নেয় না।

 

ইটিং ডিজঅর্ডারকে অবহেলা করলে তা একজন মানুষের শরীর ও মন দুই দিকেই ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সমাজে সঠিক তথ্য প্রচার, খাদ্য ও শরীর নিয়ে অস্বাস্থ্যকর সৌন্দর্য ধারণার পরিবর্তন এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া। খাবার বেঁচে থাকার উপায়, যুদ্ধের অস্ত্র নয়—এই সত্য উপলব্ধিই পারে ইটিং ডিজঅর্ডারের অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ দেখাতে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ