আপনি কি জানেন? এক চুমুক ক্যামু ক্যামু আপনার ইমিউন সিস্টেমকে করতে পারে ঝড়ের মতো শক্তিশালী!
- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
অ্যামাজনের গভীর জঙ্গলে জন্ম নেওয়া এক ছোট, লালচে ফল আজ বিশ্বজুড়ে পুষ্টিবিদ ও বিজ্ঞানীদের নজর কেড়েছে। নাম তার ক্যামু ক্যামু (Camu Camu)। চেহারায় ছোট্ট টকচোখো ফলটির চমক লুকিয়ে আছে তার ভেতরে, এতে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভিটামিন সি (Vitamin C)। এমনকি লেবু, কমলা, এমনকি কিউই,সবকিছুকেই হার মানায় এই ক্ষুদ্র অ্যামাজনীয় ফল। কিন্তু কেন ক্যামু ক্যামু-কে বলা হচ্ছে 'Vitamin C Powerhouse'? কীভাবে এটি আমাদের শরীরে কাজ করে? আর এর পেছনের বৈজ্ঞানিক কারণগুলোই বা কী? চলুন জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিতভাবে।
Camu Camu (Myciaria dubia) হলো দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন নদীর উপত্যকায় জন্মানো এক বন্য ফল। এটি এক ধরনের গুল্মজাতীয় গাছের ফল, যা সাধারণত নদীর তীরবর্তী স্যাঁতস্যাঁতে এলাকায় জন্মে। ফলটি দেখতে অনেকটা ছোট চেরির মতো। এর ব্যাস প্রায় ২–৩ সেন্টিমিটার, রঙ লালচে-বেগুনি, স্বাদে টক ও তীব্র। অ্যামাজনের স্থানীয় জনগোষ্ঠী বহু শতাব্দী ধরে এটি ব্যবহার করে আসছে রোগ প্রতিরোধ, ক্লান্তি দূর ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান যখন এর উপাদান বিশ্লেষণ শুরু করে, তখনই বিশ্ব বিস্মিত হয় এর পুষ্টিগুণে।
ভিটামিন সি মানেই আমরা সাধারণত লেবু বা কমলার কথা ভাবি। কিন্তু জানেন কি?
১০০ গ্রাম কমলায় থাকে প্রায় ৫৩ মিগ্রা ভিটামিন সি, আর ১০০ গ্রাম ক্যামু ক্যামু-তে থাকে ২,৪০০ থেকে ৩,০০০ মিগ্রা পর্যন্ত ভিটামিন সি! অর্থাৎ, কমলার তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। এ কারণেই এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক ভিটামিন সি উৎস হিসেবে স্বীকৃত।
ভিটামিন সি বা Ascorbic acid হলো একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এর প্রধান কাজ হলো শরীরের কোষগুলোকে ফ্রি র্যাডিকেলস নামের ক্ষতিকর উপাদান থেকে রক্ষা করা। এই ফ্রি র্যাডিকেলসই বয়স বাড়ায়, ত্বক নিস্তেজ করে ও নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ক্যামু ক্যামু শরীরে ভিটামিন সি-এর আধিক্যের মাধ্যমে—
⇨ ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে ⇨ ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায়, ফলে ত্বক টানটান ও উজ্জ্বল থাকে, ⇨ ইনফ্লেমেশন কমায়, ফলে ব্যথা ও ক্লান্তি হ্রাস পায় এবং স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল-এর ভারসাম্য রক্ষা করে, মানসিক প্রশান্তি আনে।
ক্যামু ক্যামু শুধু শরীর নয়, মস্তিষ্কের জন্যও দারুণ উপকারী। এর উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্কের কোষগুলোকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে,যা ডিপ্রেশন, মানসিক ক্লান্তি ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস কমাতে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ক্যামু ক্যামু পাউডার গ্রহণ করলে সেরোটোনিন উৎপাদন বাড়ে, যা "হ্যাপিনেস হরমোন" নামে পরিচিত।
এছাড়াও এতে থাকা পলিফেনল ও ফ্ল্যাভোনয়েড মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ উন্নত করে এবং মনোযোগ বৃদ্ধি করে।
ভিটামিন সি ছাড়াও ক্যামু ক্যামু-তে রয়েছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান:
⇨ পটাশিয়াম - রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
⇨ অ্যামিনো অ্যাসিড - টিস্যু গঠনে ভূমিকা রাখে
⇨ অ্যান্থোসায়ানিন ও এলাজিক অ্যাসিড - প্রদাহ ও বার্ধক্য প্রতিরোধে কার্যকর
⇨ বেটা-ক্যারোটিন ও লিউটিন - চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
ফলে এটি শুধু একটি "ভিটামিন ফল" নয়, বরং পুরো শরীরের ভারসাম্য রক্ষাকারী এক প্রাকৃতিক সম্পদ।
Journal of Agricultural and Food Chemistry (2005)-এর গবেষণায় দেখা যায়, ক্যামু ক্যামু-তে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা বিশ্বের শীর্ষ ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম। Food Chemistry (2010)-এর এক গবেষণায় বলা হয়, এতে থাকা ভিটামিন সি ও পলিফেনল যৌথভাবে শরীরে প্রদাহ কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।British Journal of Nutrition (2018)-এর একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, প্রতিদিন অল্প পরিমাণ ক্যামু ক্যামু গ্রহণ করলে ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় থাকে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
যেভাবে খাওয়া যায় ক্যামু ক্যামু-
এই ফলটি কাঁচা অবস্থায় খেতে বেশ টক, তাই সাধারণত এটি পাউডার, জুস বা ক্যাপসুল আকারে গ্রহণ করা হয়। প্রতিদিন ১–২ চা চামচ ক্যামু ক্যামু পাউডার পানি, স্মুদি বা ফলের রসে মিশিয়ে খাওয়া যায়।এটি খালি পেটে না খাওয়াই ভালো, কারণ টকভাবের কারণে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে পাকস্থলীতে অস্বস্তি হতে পারে। তবে অতিরিক্ত সেবনে (বিশেষত ভিটামিন সি-এর অতিমাত্রায়) অ্যাসিডিটি বা হালকা গ্যাস্ট্রিক সমস্যা দেখা দিতে পারে—তাই পরিমিত গ্রহণই শ্রেয়।
বিশ্বজুড়ে পুষ্টিবিদরা ইতিমধ্যেই ক্যামু ক্যামু-কে "Next Generation Superfood" হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ফলের প্রাকৃতিক বিস্তার হুমকির মুখে পড়লেও, ইতিমধ্যেই জাপান, ব্রাজিল, পেরু ও ইউরোপে এর চাষ সম্প্রসারণ শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভবিষ্যতে ক্যামু ক্যামু হতে পারে-
⇨ প্রাকৃতিক immune booster,
⇨ ত্বক-সৌন্দর্য পণ্যের প্রধান উপাদান,
⇨ এমনকি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-এজিং চিকিৎসার অংশ।
অ্যামাজনের রহস্যময় জঙ্গল থেকে উঠে আসা ক্যামু ক্যামু আজ এক বৈজ্ঞানিক বিস্ময়। এক চিমটি গুঁড়োতেই মিলছে অজস্র পুষ্টিগুণ, রোগ প্রতিরোধ ও ত্বক-সৌন্দর্যের জ্বালানি।এটি আমাদের শেখায়, ছোট একটি ফলও হতে পারে প্রকৃতির সবচেয়ে বড় উপহার।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।