বাংলাদেশে প্রতিদিন ৭০ হাজারের বেশি সাইবার হামলার চেষ্টা,এক ক্লিকেই ধ্বংস হতে পারে ডিজিটাল পরিচয়!

বাংলাদেশে প্রতিদিন ৭০ হাজারের বেশি সাইবার হামলার চেষ্টা,এক ক্লিকেই ধ্বংস হতে পারে ডিজিটাল পরিচয়!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ইন্টারনেট এখন কেবল যোগাযোগ বা বিনোদনের মাধ্যম নয়,এটি হয়ে উঠেছে জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমনকি সম্পর্ক- সবকিছু এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নির্ভরশীল।কিন্তু এই ডিজিটাল সুবিধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা,সাইবার আক্রমণ। বিশ্বজুড়ে প্রতি ৩৯ সেকেন্ডে একবার করে সাইবার আক্রমণ ঘটে (University of Maryland, 2023)।গড় হিসেবে, প্রতিদিন ৩০,০০০ ওয়েবসাইট হ্যাক হয়।

শুধু ২০২৪ সালেই, বিশ্ব অর্থনীতিতে সাইবার অপরাধের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার,যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সমান! বাংলাদেশে ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে CERT (Computer Emergency Response Team) রেকর্ড করেছে প্রায় ২.৫ কোটি সাইবার আক্রমণের চেষ্টা, যার লক্ষ্য ছিল ব্যাংক, ই-কমার্স, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ ব্যবহারকারীর স্মার্টফোন।
 

সাইবার আক্রমণ আসলে এক ধরনের ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি বা অপরাধ, যেখানে অপরাধীরা আপনার ডিভাইসে প্রবেশ করে তথ্য চুরি করে বা সেটি নিয়ন্ত্রণ নেয়।এগুলো মূলত দুইভাবে হয়-
 

১। প্রযুক্তিগত আক্রমণ (Technical Attack) - যেমন ম্যালওয়্যার, ভাইরাস, র‍্যানসমওয়্যার।

২। মনস্তাত্ত্বিক আক্রমণ (Social Engineering) - যেখানে হ্যাকাররা মানুষের বিশ্বাস, কৌতূহল বা ভয়কে কাজে লাগিয়ে ফাঁদ পাতে।
 

সাধারণ আক্রমণের ধরনসমূহ:

১. Phishing:
ভুয়া ইমেইল বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করা হয়। তাই সন্দেহজনক লিঙ্কে কখনও ক্লিক করবেন না।
 

২. Ransomware:
ফাইল এনক্রিপ্ট করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়।

নিয়মিত ব্যাকআপ রাখুন এবং ইমেইল ফাইল খোলার আগে যাচাই করুন।
 

৩. Spyware:গোপনে ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করে।

অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন এবং সিস্টেম আপডেট রাখুন।
 

৪. DDoS Attack:সার্ভার বা ওয়েবসাইটে অতিরিক্ত ট্রাফিক পাঠিয়ে ক্র্যাশ করানো হয়।
ফায়ারওয়াল ও ক্লাউড প্রটেকশন ব্যবহার করুন।
 

৫. Credential Stuffing:একই পুরনো পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে একাধিক অ্যাকাউন্টে লগইন করার চেষ্টা করা হয়।

প্রতিটি সাইটে আলাদা ও শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
 

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেন, "The weakest link is not the computer, it's the human."অর্থাৎ প্রযুক্তির দুর্বলতা নয়, মানুষের আবেগই হ্যাকারদের মূল অস্ত্র। তারা ইমেইল বা মেসেজে এমনভাবে ভয় বা লোভ জাগায় যাতে মানুষ না ভেবে ক্লিক করে ফেলে। যেমন-

"আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে।"বা "আপনি ৫০,০০০ টাকা জিতেছেন! এখনই লিঙ্কে ক্লিক করুন।"

এটি মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে "সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং",এক ধরনের মানসিক প্রতারণা, যেখানে আপনার মনস্তত্ত্বকেই টার্গেট করা হয়।

 

প্রতিরোধের বাস্তব কৌশল: 

১। শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করুন। পাসওয়ার্ডে অন্তত ১২টি ক্যারেক্টার রাখুন (অক্ষর + সংখ্যা + প্রতীক)।"password123" বা নিজের নাম ব্যবহার করবেন না। পাসওয়ার্ড ম্যানেজার (যেমন Bitwarden, 1Password) ব্যবহার করতে পারেন।
 

২। টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন (2FA) চালু রাখুন।

এটি পাসওয়ার্ডের পর অতিরিক্ত নিরাপত্তা স্তর দেয়- একটি কোড আসে আপনার ফোনে বা ইমেইলে, যা হ্যাকার জানে না।
 

৩।  সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট করুন।

সফটওয়্যার আপডেট মানে শুধুই নতুন ফিচার নয়—এর ভেতরে থাকে security patch, যা দুর্বল জায়গা বন্ধ করে দেয়।
 

৪।  ইমেইল ও লিঙ্ক যাচাই করুন। প্রেরকের ঠিকানা খুঁটিয়ে দেখুন। বানান ভুল বা অদ্ভুত ডোমেইন (.xyz, .click) থাকলে দূরে থাকুন। কোনো ব্যাংক কখনোই ইমেইলে পাসওয়ার্ড চাইবে না।
 

৫। পাবলিক ওয়াই-ফাই থেকে লগইন করবেন না। কফিশপ বা বিমানবন্দরের ফ্রি ওয়াই-ফাইতে তথ্য পাঠালে তা হ্যাকার "sniffing tool" দিয়ে পড়তে পারে।সমাধান: "VPN" ব্যবহার করুন।
 

৬।  সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমিত তথ্য প্রকাশ করুন

জন্মতারিখ, স্কুল, বা মায়ের নামের মতো তথ্য পাসওয়ার্ড রিকভারি প্রশ্নের অংশ হয়।এই তথ্য প্রকাশ করলে হ্যাকার সহজেই অনুমান করতে পারে আপনার লগইন।
 

৭।  নিয়মিত ব্যাকআপ রাখুন। গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ক্লাউডে (Google Drive, OneDrive) বা এক্সটার্নাল হার্ডড্রাইভে রাখলে র‍্যানসমওয়্যারের পরও ডেটা ফেরত পাওয়া যায়।


 

পরিবারের সাইবার নিরাপত্তা-

শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারকারী। শিশুদের শেখান যে অনলাইন গেম বা লিঙ্কে ক্লিক করার আগে বাবা-মাকে দেখাতে হবে। বয়স্কদের জানাতে হবে OTP বা PIN কারও সাথে শেয়ার করা যাবে না।

বর্তমানে অনেক সাইবার নিরাপত্তা সিস্টেম Machine Learning দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্যাকিং প্যাটার্ন চিনে ফেলে।তবে একই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে হ্যাকাররাও।ফলে, ভবিষ্যতের সাইবার যুদ্ধ হবে AI বনাম AI, যেখানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হবে স্বশিক্ষিত বুদ্ধিমত্তায়।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ফারুক হোসেন বলেন, "বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সচেতনতার অভাব। আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করি, কিন্তু নিরাপত্তা বুঝি না। ডিজিটাল সুরক্ষার মূল ভিত্তি হলো আচরণ পরিবর্তন।"

AI গবেষক ড. নাফিসা রহমানের মতে,"আগামী দশকে ব্যক্তিগত ডেটাই হবে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাই ডেটা রক্ষায় বিনিয়োগ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।"

ইন্টারনেটের জগতে আমরা সবাই সৈনিক, আর আমাদের অস্ত্র হলো সচেতনতা।একটি অসাবধান ক্লিকই খুলে দিতে পারে পুরো ডিজিটাল জীবন। তাই মনে রাখুন-অনলাইনে প্রতিটি ক্লিক মানে একটি সিদ্ধান্ত,আর প্রতিটি সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে আপনি নিরাপদ না ঝুঁকিতে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ