"ঘাড়ের টান" আধুনিক জীবনের নীরব যন্ত্রণা: কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
অফিসের চেয়ারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসা, ফোনে মাথা নিচু করে থাকা বা হালকা ঠান্ডা হাওয়া এই সব মিলেই 'ঘাড়ের রোগ' আজ ঘরে ঘরে বাস্তব সমস্যা হয়ে উঠছে। "ঘাড়ে টান", "ঘাড় ব্যথা" বা "ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া" এই সমস্যাটি এখন প্রায় সবার ঘরেই দেখা যায়। একে অনেকে "ঘরের রোগ" বলেই চেনেন, কারণ এটি সাধারণ, কিন্তু বারবার ফিরে আসে এবং অবহেলা করলে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ফোন বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে নিচু হয়ে তাকিয়ে থাকেন, তাদের প্রায় ৭০% মানুষের ঘাড়ে নিয়মিত পেশী টান ও ব্যথা দেখা দেয়।
কেন ঘাড়ে টান বা ব্যথা হয়?
১. ভুল ভঙ্গি (Poor Posture): দীর্ঘ সময় ধরে মাথা নিচু করে ফোন দেখা বা ল্যাপটপে কাজ করার ফলে ঘাড়ের পেছনের পেশীগুলোতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এতে পেশী সংকুচিত হয়ে যায়, স্নায়ু চাপে আসে ফলে টান, ব্যথা বা শক্ত হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়।
২. ঠান্ডা বাতাস বা এসির প্রভাব: ঘাড়ে সরাসরি ঠান্ডা বাতাস লাগলে (বিশেষ করে ঘুমের সময় বা গাড়িতে) ঘাড়ের পেশীগুলো হঠাৎ সঙ্কুচিত হয়ে ব্যথা ও জড়তা তৈরি করতে পারে।
৩. পেশীর টান (Muscle Strain): হঠাৎ ঘাড় ঘোরানো, ভারি কিছু তোলা বা ঘুমের সময় অস্বস্তিকর ভঙ্গি থেকেও পেশী টান ধরে যায়। অনেক সময় ব্যথা কাঁধ বা পিঠ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
৪. স্নায়ু চাপে আসা (Nerve Compression): মেরুদণ্ডের ঘাড় অংশে হাড়ের জোড়া বা ডিস্ক সামান্য সরলে স্নায়ু চাপে আসে এতে ব্যথা, অবশভাব বা হাতে ঝিনঝিন ভাব হতে পারে।
৫. প্রদাহ বা হালকা সংক্রমণ: ঠান্ডা, ভাইরাল ইনফেকশন বা দীর্ঘস্থায়ী পেশী প্রদাহ থেকেও ঘাড়ে টান ও ফোলা দেখা দেয়।
ঘাড়ের টান বা ব্যথা কমানোর ঘরোয়া প্রতিকার:
১. উষ্ণ সেঁক (Warm Compress) দিন। একটি তোয়ালে গরম পানিতে ভিজিয়ে ১০ মিনিট ঘাড়ে ধরে রাখুন। দিনে ২–৩ বার করলে পেশী শিথিল হয় ও ব্যথা কমে।
২. মৃদু ম্যাসাজ ও হালকা স্ট্রেচিং করুন! অল্প তেল গরম করে হালকা হাতে ঘাড় ও কাঁধে ম্যাসাজ করুন। এরপর ধীরে ধীরে মাথা ডান–বাম দিকে ঝুকিয়ে স্ট্রেচিং করুন। এটি রক্ত চলাচল বাড়ায়।
৩. সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন। ফোন চোখের সমান উচ্চতায় ধরুনএবং ল্যাপটপে কাজের সময় মনিটর চোখের সমান রাখুন।একটানা ৩০–৪০ মিনিটের বেশি বসে কাজ করবেন না। মাঝে উঠে হালকা নড়াচড়া করুন।
৪. পর্যাপ্ত পানি ও ম্যাগনেশিয়াম গ্রহণ করুন। ডিহাইড্রেশন ও মিনারেল ঘাটতি পেশী টান বাড়ায়। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং খাবারে কলা, ডাল, বাদাম ও সবুজ শাক রাখুন।
৫. সঠিক বালিশ ব্যবহার। অতিরিক্ত উঁচু বা শক্ত বালিশ ঘাড়ের প্রাকৃতিক বাঁক নষ্ট করে ব্যথা বাড়ায়। নরম, মাঝারি উচ্চতার বালিশ ব্যবহার করুন।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি:
☞ ব্যথা এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়
☞ ঘাড়ের সঙ্গে হাত বা আঙুলে অবশভাব বা ঝিনঝিন ভাব আসে
☞ ঘাড় ফুলে যায় বা জ্বর হয়
☞ মাথা ঘোরালে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়
এগুলো স্নায়ু বা মেরুদণ্ডের জটিল সমস্যার ইঙ্গিত হতে পারে, তাই দেরি না করে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।
প্রতিরোধের উপায়:
⇨ প্রতিদিন হালকা ঘাড়ের ব্যায়াম বা যোগাভ্যাস করুন।
⇨ মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহারের সময় ঘাড় নিচু না করে চোখের সমান উচ্চতায় রাখুন।
⇨ ঘুমের সময় ফ্যান বা এসির বাতাস সরাসরি ঘাড়ে পড়তে দেবেন না।
⇨ পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন। চাপ ও মানসিক স্ট্রেস ঘাড়ের ব্যথা বাড়ায়।
⇨ নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। এটি পেশীকে শক্ত রাখে ও রক্ত চলাচল সচল রাখে।
ঘাড়ের টান বা ব্যথা আজকাল এত সাধারণ হয়ে উঠেছে যে অনেকেই একে অবহেলা করেন। কিন্তু এই সাধারণ ব্যথার মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে ভবিষ্যতের জটিল সমস্যা, স্নায়ু চাপে আসা বা সারভাইক্যাল ডিস্কজনিত সমস্যা। তাই প্রতিদিনের জীবনে সচেতন ভঙ্গি, নিয়মিত ব্যায়াম, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং সামান্য যত্নই পারে ঘাড়ের এই "নীরব যন্ত্রণা"কে থামাতে। ঘাড় ব্যথা মানেই বয়স নয়, বরং আধুনিক অভ্যাসের ক্লান্ত মাশুল। এখনই সচেতন হোন, নয়তো ব্যথাই হবে প্রতিদিনের সঙ্গী।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।