এক মিনিটের ভিডিও: অ্যালকোহলের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর

এক মিনিটের ভিডিও: অ্যালকোহলের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর
ছবির ক্যাপশান, এক মিনিটের ভিডিওর নেশা মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও আবেগের ভারসাম্য নষ্ট করছে পাঁচ গুণ বেশি যা মাঝারি অ্যালকোহলের চেয়েও ক্ষতিকর,জানেন কি!!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আজকের দিনে ফোনে আঙুলের এক টাচেই পৃথিবী বদলে যাচ্ছে খবর, বিনোদন, রেসিপি, নাচ, কৌতুক, সবই হাতের মুঠোয়। কিন্তু এই দ্রুততর জগতের নেপথ্যে নীরবে বদলে যাচ্ছে মানব মস্তিষ্কের কাজের ধরন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, TikTok, Instagram Reels কিংবা YouTube Shorts-এর মতো ক্ষুদ্র ভিডিও প্ল্যাটফর্মে বারবার স্ক্রল করা এখন শুধু সময়ের অপচয় নয়, এটি আমাদের মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। গবেষকরা তুলনা করে বলছেন, এই ক্ষতি মাঝারি পরিমাণ অ্যালকোহল সেবনের প্রভাবের চেয়েও প্রায় পাঁচগুণ বেশি। কারণ, যেখানে অ্যালকোহল সাময়িকভাবে স্নায়ুতন্ত্রকে ধীর করে দেয়, সেখানে অতিরিক্ত স্ক্রলিং মস্তিষ্ককে "অতিরিক্ত সক্রিয়" অবস্থায় আটকে রাখে, যেন মস্তিষ্ক নিজেই আর বিশ্রাম নিতে ভুলে যায়।

কীভাবে ছোট ভিডিও আমাদের মস্তিষ্ককে পুনঃপ্রশিক্ষিত করছে!

মানব মস্তিষ্ক আনন্দ পায় ডোপামিন নামের এক রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে। ডোপামিন যখন নিঃসৃত হয়, তখন আমরা তৃপ্তি বা আনন্দ অনুভব করি। সাধারণত এই নিঃসরণ হয় কোনো কাজ সম্পন্ন করার পর, সাফল্য পাওয়ার পর, বা কোনো প্রশংসা শুনলে। কিন্তু ক্ষুদ্র ভিডিও বা শর্টস প্ল্যাটফর্মগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে প্রতিটি নতুন ভিডিওই মস্তিষ্কে এক ক্ষুদ্র "ডোপামিন হিট" দেয়। অর্থাৎ, আপনি যখন একটির পর একটি ভিডিও দেখছেন, তখন মস্তিষ্ক ক্রমাগত ক্ষুদ্র আনন্দের স্রোতে ভাসছে।

সমস্যা হলো এই দ্রুত, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের ফলে মস্তিষ্ক "তাৎক্ষণিক পুরস্কার" (instant gratification)-এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। ফলে, যে কাজগুলোতে ধৈর্য, সময় বা পরিশ্রম দরকার, যেমন- পড়াশোনা, লেখালেখি, গবেষণা বা কোনো প্রজেক্টে মনোনিবেশ, সেগুলো ক্রমশ মস্তিষ্কের কাছে "বিরক্তিকর" মনে হতে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত স্ক্রলিং ধীরে ধীরে "Attention Span Collapse" বা মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতার ভাঙন ঘটায়। এই অবস্থায় দেখা যায়

☞ বই বা প্রবন্ধ পড়তে গেলে মন কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্যদিকে চলে যায়। 

☞ কাজের মাঝেই ফোন চেক করার অদম্য ইচ্ছা জাগে।

☞ ক্লাস, মিটিং বা আলোচনা চলাকালেও মনোযোগ হারিয়ে যায়।

☞ ধীর গতির কোনো ভিডিও, গান বা কথোপকথন বিরক্তিকর লাগে।

এই লক্ষণগুলো শুরুতে তুচ্ছ মনে হলেও, সময়ের সঙ্গে তা দীর্ঘমেয়াদী মস্তিষ্কগত ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়।

নিউরোসায়েন্স গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত স্ক্রলিং মস্তিষ্কের পুরস্কার-নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র নিউক্লিয়াস অ্যাকম্বেন্স (Nucleus Accumbens)- কে অতিরিক্ত উত্তেজিত করে তোলে। এতে মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা দ্রুত বাড়ে এবং দ্রুতই কমে যায়।

ফলে, আপনি যখন ফোন নামিয়ে রাখেন, তখন হঠাৎই এক ধরনের শূন্যতা বা বিরক্তি অনুভূত হয়। এটাই সেই মুহূর্ত, যখন আপনি আবার ফোন হাতে নেন, আরেকটি ভিডিও দেখার জন্য। এভাবেই তৈরি হয় 'ডোপামিন লুপ', যা মাদকাসক্তির মতোই আচরণ তৈরি করে, যদিও তাতে কোনো পদার্থিক নেশা নেই।

এই প্রক্রিয়া শুধু মনোযোগ নয়, আবেগকেও প্রভাবিত করে। মস্তিষ্ক যখন অভ্যস্ত হয়ে যায় দ্রুত পুরস্কারে, তখন "বিলম্বিত সন্তুষ্টি" (Delayed Gratification) পাওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এর ফল

◑ ধৈর্যের অভাব

◑ উদ্বেগ ও অস্থিরতা বৃদ্ধি

◑ মানসিক স্থিতিশীলতার ঘাটতি

◑ সামান্য ব্যর্থতা বা একঘেয়েমিতেও রাগ বা ক্লান্তি

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই পরিবর্তন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে, কারণ তাদের মস্তিষ্ক এখনো সম্পূর্ণ পরিপক্ব হয়নি। তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এই প্রভাব উল্টাতে চাইলে মস্তিষ্ককে "ডিটক্স" করতে হবে, অর্থাৎ অতি উদ্দীপক কনটেন্ট থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরাতে হবে।

১. ডিজিটাল সীমা নির্ধারণ করুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় স্ক্রিন ব্যবহারের পর আর স্ক্রল করবেন না।

২. ডোপামিন ডিটক্স দিন।  সপ্তাহে একদিন বা কয়েক ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়া একদম ব্যবহার না করা।

৩. ধীর আনন্দে অভ্যস্ত হন। বই পড়া, ব্যায়াম, রান্না, প্রকৃতিতে হাঁটা এই ধরনের কাজ মস্তিষ্কে স্থায়ী তৃপ্তি তৈরি করে।

৪. ঘুম ও খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখুন।  ঘুমের অভাব ও অস্বাস্থ্যকর খাবার ডোপামিনের ভারসাম্য আরও নষ্ট করে।

৫. নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন।  প্রতিটি 'পিং' মস্তিষ্ককে এক ক্ষুদ্র বিভ্রান্তির ফাঁদে ফেলে।

মস্তিষ্ক কোনো যন্ত্র নয়, এটি এক জীবন্ত অঙ্গ, যা সময় ও প্রশান্তি চায়। প্রযুক্তি আমাদের সহায়ক হতে পারে, কিন্তু যখন সেটি মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখনই শুরু হয় ক্ষয়ের প্রক্রিয়া। তাই, সচেতনভাবে সময়ের ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল সীমা নির্ধারণ, এবং ধীর আনন্দে ফেরার চর্চাই মস্তিষ্ককে পুনরায় ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনতে পারে। "স্ক্রল বন্ধ করুন, দেখবেন চিন্তা আবার গভীর হচ্ছে।"এই বার্তাটিই হয়তো ডিজিটাল যুগে মস্তিষ্ক বাঁচানোর সবচেয়ে বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক পরামর্শ।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ