হার্টবিট কমে, মানসিক প্রশান্তি বাড়ে হৃদয়কে শান্ত রাখার অদেখা সূত্র!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
আজকের জীবন ছুটে চলছে দ্রুতগতির চাপে। মোবাইলের নোটিফিকেশন, কাজের ডেডলাইন, তথ্যের ভিড় সব মিলিয়ে মস্তিষ্ক সারাক্ষণ উত্তেজিত অবস্থায় থাকে। এই উত্তেজনাই বাড়ায় স্ট্রেস হরমোন (কর্টিসল), যা হৃদস্পন্দন বাড়ায় ও শরীরে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে দেখা গেছে যখন আমরা কোনো বই পড়ি, তখন শরীর ধীরে ধীরে সেই উত্তেজনা থেকে সরে এসে একপ্রকার "রিল্যাক্সড রেসপন্স"-এ চলে যায়। যেন মস্তিষ্ক নিজে থেকেই বলে ওঠে,"এবার একটু শান্ত হও।"এই সময়েই আমাদের হৃদস্পন্দন ধীরে হয়, রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়, আর মস্তিষ্কের কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে চলতে থাকে।
মানব শরীরের স্নায়ুতন্ত্র দুটি ভাগে কাজ করে
১। Sympathetic System: এটি সক্রিয় হয় যখন আমরা উত্তেজিত বা চাপগ্রস্ত থাকি।
২। Parasympathetic System: এটি সক্রিয় হয় যখন শরীর বিশ্রাম নেয় ও শান্ত থাকে। যখন আমরা বই পড়ি, তখন মনোযোগ গল্প বা ভাবনায় কেন্দ্রীভূত হয়। এটি মস্তিষ্ককে বাইরের স্ট্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন করে Parasympathetic System সক্রিয় করে।
ফলাফল:
⇨ হৃদস্পন্দন ৫–১০ বিট প্রতি মিনিট পর্যন্ত কমে যেতে পারে (হালকা পড়ার সময়)।
⇨ শ্বাসপ্রশ্বাস গভীর ও নিয়মিত হয়।
⇨ পেশি শিথিল হয়, রক্তচাপ স্থিতিশীল থাকে।
অর্থাৎ, বই পড়ার সময় শরীর নিজেকে "বিপদমুক্ত" বা "নিরাপদ অবস্থায়" ভাবতে শুরু করে।
আমাদের আবেগ, চিন্তা ও হৃদযন্ত্র একে অপরের সঙ্গে জৈবভাবে যুক্ত। মস্তিষ্কের amygdala ও hypothalamus নামের দুটি অংশ আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, আর সেখান থেকেই স্নায়বিক সংকেত যায় হৃদপিণ্ডে। যখন আমরা উত্তেজিত বা উদ্বিগ্ন, তখন হৃদপিণ্ডে দ্রুত সংকেত যায় "লড়াই করো বা পালাও।" কিন্তু যখন আমরা পড়ার মধ্যে নিমগ্ন, তখন সেই বিপরীত সংকেত কাজ করে "শান্ত হও, তুমি নিরাপদ।" এই সময় শরীরে অক্সিটোসিন ও সেরোটোনিন নামের 'শান্তির হরমোন' বৃদ্ধি পায়, যা শুধু মনকেই নয়, শরীরকেও বিশ্রামের অনুভূতি দেয়।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, বই পড়া মস্তিষ্কে ঠিক যেভাবে কাজ করে, ধ্যানও সেভাবেই কাজ করে। উভয় ক্ষেত্রেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয় এক জায়গায়, এবং অবচেতন মন থেকে উদ্বেগময় চিন্তা দূর হতে থাকে। যখন কেউ বইয়ে সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায়
মস্তিষ্কের 'default mode network' ধীরে কাজ করে (যা চিন্তা ও উদ্বেগে সক্রিয় থাকে)। মনোযোগের অঞ্চল 'prefrontal cortex' বেশি সক্রিয় হয়।
এতে মন শান্ত হয়, এবং মস্তিষ্কের স্নায়ুবিক ছন্দ স্থিতিশীল হয়। এই অবস্থাকেই মনোবিজ্ঞানীরা বলেন "cognitive calm state" যা হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
সব ধরনের পড়া একই প্রভাব ফেলে না। মনোযোগপূর্ণ, শান্ত ও মননশীল পড়া (যেমন সাহিত্য, জীবনী, বিজ্ঞান বা দর্শনমূলক বই) মানসিক প্রশান্তিতে বেশি কার্যকর।
◑ গল্প বা উপন্যাস: কল্পনার জগতে নিয়ে যায়, মানসিক সংযোগ তৈরি করে, হৃদয়কে কোমল করে।
◑ বিজ্ঞান বা মননশীল বই: চিন্তাশক্তি বাড়ায়, মস্তিষ্কে সচেতন শান্তি আনে।
◑ কবিতা বা দর্শনমূলক লেখা: ছন্দ ও ভাবনামূলক শব্দে মনকে প্রশান্ত করে এটি একধরনের ধ্যানমূলক অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে, উত্তেজনামূলক বা নেতিবাচক খবর পড়লে হৃদস্পন্দন বাড়তে পারে। তাই রাতে ঘুমানোর আগে হালকা বা ইতিবাচক বই পড়া সবচেয়ে উপকারী।
যারা নিয়মিত বই পড়েন, তাঁদের মধ্যে ঘুমের মান ভালো হয়, কারণ এই অভ্যাস মস্তিষ্কে মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখে। স্ক্রিনের নীল আলো যেখানে ঘুমে বাধা দেয়, বই সেখানে ঘুমকে স্বাভাবিক করে তোলে। এছাড়া পড়ার সময় মস্তিষ্ক মনোযোগ ধরে রাখতে শেখে, যা দৈনন্দিন কাজেও সহায়তা করে। এটি উদ্বেগ, মনোযোগ ঘাটতি ও মানসিক ক্লান্তি কমায়।
শরীরচর্চা যেমন হৃদপিণ্ডকে শক্তিশালী করে, তেমনি মানসিক প্রশান্তিও হৃদয়ের সুস্থতায় প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ২০–৩০ মিনিট শান্তভাবে বই পড়েন, তাঁদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কিছুটা কমে। কারণ, প্রশান্ত মন সরাসরি প্রভাব ফেলে স্নায়ুতন্ত্রের ওপর, যা হৃদয়ের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ, বই পড়া এক অর্থে "mental cardiac exercise" যা হৃদয় ও মন, দুটোকেই শান্ত রাখে।
আজকের একাকিত্বে ভরা ডিজিটাল জীবনে বই যেন এক মানবিক সঙ্গী। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে আমরা ফিরে পাই চিন্তার নিরবতা, অনুভূতির উষ্ণতা। এই সংযোগ মানসিক চাপ কমায় এবং মনকে পুনরায় জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত করে। "বই পড়া মানে নিঃসঙ্গতা নয় এটি নিজের ভেতরের জগতে এক গভীর ভ্রমণ।"
বই পড়া কখনোই কেবল জ্ঞান আহরণের মাধ্যম নয়, এটি শরীর ও মনের সংলাপের এক গভীর প্রক্রিয়া। পাতার পর পাতা উল্টাতে উল্টাতে যখন মন গল্পের ভেতরে হারিয়ে যায়, শরীরও সেই ছন্দে নিজেকে শান্ত করে ফেলে। একটি বই মানে কখনো শুধু কাহিনি নয়, বরং নিঃশব্দে বয়ে যাওয়া এক প্রশান্ত স্রোত যা হৃদয়ের তাল ঠিক রাখে, মনকে করে হালকা, আর জীবনকে এনে দেয় ভারসাম্যের সৌন্দর্য।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।