জল ও জীবনের খোঁজে এক্সোপ্ল্যানেট: মহাকাশের নতুন রহস্য

জল ও জীবনের খোঁজে এক্সোপ্ল্যানেট: মহাকাশের নতুন রহস্য
ছবির ক্যাপশান, জল ও জীবনের খোঁজে এক্সোপ্ল্যানেট: মহাকাশের নতুন রহস্য
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

পৃথিবীর নীল আকাশের ওপারে, অসংখ্য নক্ষত্রের আলোর মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে অজানা গ্রহের দল, যেগুলোকে আমরা বলি এক্সোপ্ল্যানেট। আজ থেকে কয়েক দশক আগেও এগুলো ছিল বিজ্ঞানীদের কল্পনা, কিন্তু আধুনিক টেলিস্কোপ প্রযুক্তি এখন সেই কল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করেছে। ১৯৯০-এর দশকে প্রথম এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কারের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫,৫০০-এরও বেশি এক্সোপ্ল্যানেট শনাক্ত করা হয়েছে। এই গ্রহগুলোই আজ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ, এদের কিছু হয়তো জীবনের অস্তিত্ব বহন করছে।

"এক্সো" শব্দের অর্থ 'বাইরের'। অর্থাৎ এক্সোপ্ল্যানেট বলতে বোঝায় পৃথিবীর সৌরজগতের বাইরের কোনো নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান গ্রহ। যেমন পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, তেমনভাবেই এসব এক্সোপ্ল্যানেট তাদের নিজ নিজ নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে।

প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীরা এই গ্রহগুলো শনাক্ত করেন "ট্রানজিট পদ্ধতি" ও "রেডিয়াল ভেলোসিটি পদ্ধতি" ব্যবহার করে, যেখানে নক্ষত্রের আলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয়, কোনো গ্রহ তার সামনে দিয়ে অতিক্রম করছে কি না, বা নক্ষত্রের গতিতে সামান্য টান দেখা দিচ্ছে কি না। এই ক্ষুদ্র আলো-ছায়ার পরিবর্তনই জানিয়ে দেয়, মহাকাশের কোথাও ঘুরছে নতুন এক পৃথিবী।

জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান হলো পানি। জীববিজ্ঞানীরা মনে করেন, পানি ছাড়া জৈব রসায়ন সম্ভব নয়। প্রোটিন, ডিএনএ, কার্বোহাইড্রেটসহ জীবনের মৌলিক রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো পানির মাধ্যমেই ঘটে। তাই এক্সোপ্ল্যানেট অনুসন্ধানে জলীয় উপস্থিতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST)-এর সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে কিছু এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। উদাহরণ হিসেবে K2-18b নামের গ্রহটি যা পৃথিবী থেকে প্রায় ১২০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এর বায়ুমণ্ডলে জলীয় অণুর উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এটি "সুপার আর্থ" বা "মিনি-নেপচুন" ধরনের একটি গ্রহ, যার পৃষ্ঠতল আংশিকভাবে তরল জল ধারণ করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এক্সোপ্ল্যানেট গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো হ্যাবিটেবল জোন বা "বাসযোগ্য অঞ্চল"। কোনো নক্ষত্রের চারপাশে এমন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল থাকে যেখানে তাপমাত্রা এমনভাবে ভারসাম্যপূর্ণ যে সেখানে জল তরল অবস্থায় থাকতে পারে। পৃথিবী সূর্যের এই অঞ্চলে অবস্থান করছে বলেই এখানে জীবনের বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটগুলোর মধ্যে বহু গ্রহই তাদের নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে অবস্থান করছে। যেমন Kepler-452b, TRAPPIST-1e, Proxima Centauri b, Kepler-22b ইত্যাদি। এর মধ্যে TRAPPIST-1 নামের নক্ষত্রব্যবস্থায় সাতটি পৃথিবীর আকারের গ্রহ রয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত তিনটি এমন দূরত্বে যেখানে তরল পানি থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠন। বিজ্ঞানীরা খুঁজছেন কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস, ও সালফারের উপস্থিতি। কারণ, এগুলোই জীবনের রাসায়নিক ভিত্তি তৈরি করে।

কিছু এক্সোপ্ল্যানেটে মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের উপস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই উপাদানগুলো প্রাকৃতিকভাবে আগ্নেয়গিরি বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় তৈরি হতে পারে, তবে জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ফলাফলও হতে পারে। বিজ্ঞানীরা একে বলেন বায়োসিগনেচার—অর্থাৎ জীবনের সম্ভাব্য রাসায়নিক ছাপ।

সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ:

যদিও এসব আবিষ্কার আশাব্যঞ্জক, তবুও বাস্তবতা হলো এই পর্যবেক্ষণগুলো সবই পরোক্ষ। আমরা এখনো কোনো এক্সোপ্ল্যানেটের পৃষ্ঠতল সরাসরি দেখতে পারিনি। বিশাল দূরত্ব, আলো-প্রতিফলনের সীমাবদ্ধতা এবং যন্ত্রের সংবেদনশীলতা এখনো বড় বাধা।

এছাড়া, অনেক সময় যেসব উপাদানকে জলীয় বাষ্প বা মিথেন মনে করা হয়, সেগুলো আসলে ভিন্ন রাসায়নিক যৌগও হতে পারে। তাই এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর বাইরে জীবনের উপস্থিতির বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নিশ্চিতভাবে পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞানীরা এখন এমন প্রযুক্তি তৈরি করছেন যা এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল আরও স্পষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) ইতিমধ্যেই কয়েকটি নতুন মিশনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যেমন:

◑ LUVOIR (Large UV Optical Infrared Surveyor) – এটি এমনভাবে তৈরি হবে যাতে দূরবর্তী গ্রহের বায়ুমণ্ডল থেকে সরাসরি স্পেকট্রাম বিশ্লেষণ করে জীবনের রাসায়নিক ছাপ খুঁজে বের করা যায়।

◑ HabEx (Habitable Exoplanet Observatory) – এই টেলিস্কোপের মূল লক্ষ্য পৃথিবী-সদৃশ গ্রহ শনাক্ত করা এবং তাদের চারপাশের জল, বায়ুমণ্ডল ও মেঘ বিশ্লেষণ করা।

◑ Ariel Mission (ESA) – ইউরোপীয় মিশনটি এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলের উপাদান নির্ণয়ে বিশেষভাবে পরিকল্পিত।

- এই প্রকল্পগুলো আগামী দশকে এক্সোপ্ল্যানেট গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

মানব সভ্যতা হয়তো একসময় বুঝতে পারবে, মহাবিশ্বে জীবন কোনো বিরল ঘটনা নয়, বরং প্রকৃতির একটি সাধারণ ফলাফল। হয়তো কোথাও কোনো নীলাভ আকাশের নিচে, অপরিচিত কোনো জীব আজও জলাশয়ের ধারে শ্বাস নিচ্ছে। যেমন, একদিন কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ শ্বাস নিয়েছিল। এক্সোপ্ল্যানেটের সন্ধান তাই শুধু মহাকাশবিজ্ঞানের গবেষণা নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ববোধের গভীরে এক মৌলিক অনুসন্ধান আমরা কোথা থেকে এসেছি, আর মহাবিশ্বে আমাদের মতো কেউ কি আছে?

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ