জলবায়ুর হুমকির বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাফল্য কৃত্রিম গাছের উদ্ভাবন !

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন আর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয় এটি বাস্তব সংকট। বরফ গলছে দ্রুত, তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, এবং পৃথিবীর শ্বাস-প্রশ্বাস যেন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই অবস্থায় কার্বন ডাই-অক্সাইড কমানোই এখন মানবজাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু যখন প্রাকৃতিক বনভূমি কাটা পড়ছে আর গাছ লাগানোর হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় সামান্য, তখন প্রযুক্তিই হয়ে উঠছে সম্ভাবনার আলো। এই প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এক অভিনব ধারণা "কৃত্রিম গাছ" বা Artificial Tree যা মানুষের তৈরি এমন এক যন্ত্র, যা প্রকৃত গাছের মতোই বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে।
গাছই পৃথিবীর ফুসফুস। এটি বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন ছাড়ে। কিন্তু প্রতি বছর পৃথিবী প্রায় ১০ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি হারাচ্ছে, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙে দিচ্ছে। গবেষণা বলছে, এখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বনের ঘনত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা গত ৮ লক্ষ বছরে কখনও দেখা যায়নি। এই অতিরিক্ত কার্বনই গ্লোবাল ওয়ার্মিং, খরা, বন্যা ও জলবায়ু বিপর্যয়ের মূল কারণ।
বন সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক হলেও একা গাছ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, প্রকৃত গাছ কার্বন শোষণ করে তুলনামূলকভাবে ধীরে। সেখানেই প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ কৃত্রিম গাছ। এই যন্ত্রগুলো এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যেন তারা হাজারগুণ দ্রুত গতিতে বায়ু থেকে কার্বন শোষণ করতে পারে, এবং তা সংরক্ষণ বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য আকারে রূপান্তর করা যায়।
এই কৃত্রিম গাছগুলোর মূল ধারণা হলো বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেঁকে নেওয়া, একে সংরক্ষণ করা, এবং প্রয়োজনে পুনরায় ব্যবহার করা। এগুলোতে ব্যবহার করা হয় একধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা বাতাসে থাকা CO₂-র সঙ্গে বিক্রিয়া করে তাকে ধরে রাখে। কিছু প্রযুক্তি পদ্ধতিতে ফ্যান বা পাম্প ব্যবহার করে বায়ু টেনে নেওয়া হয় (active capture), আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বাতাসের গতিবিধিই যথেষ্ট হয় (passive capture)।
কৃত্রিম গাছ বাতাস থেকে CO₂ শোষণ করে নির্দিষ্ট চেম্বারে জমা করে। তারপর উচ্চ তাপ প্রয়োগে এই CO₂ আলাদা করে নেওয়া হয়, যা সংরক্ষণ করা যায় ভূগর্ভে বা ব্যবহার করা যায় শিল্পকারখানায়। কিছু প্রযুক্তি এই গ্যাসকে রূপান্তর করে জ্বালানি বা নির্মাণ উপাদান হিসেবে ব্যবহারযোগ্য করে তুলছে। একটি সাধারণ কৃত্রিম গাছ দিনে প্রায় এক টন পর্যন্ত কার্বন শোষণ করতে পারে, যা প্রায় ১,০০০টি প্রকৃত গাছের সমান।
প্রযুক্তির এই দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশ। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি সংস্থা যৌথভাবে "Mechanical Tree" প্রকল্প চালাচ্ছে। এটি দেখতে ধাতব পাতার মতো বড় কাঠামো, যা বাতাসের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বন শোষণ করে।
আইসল্যান্ডে Climeworks নামের একটি প্রতিষ্ঠান "Orca" নামে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম কার্বন ক্যাপচার প্লান্ট তৈরি করেছে। সেখানে প্রতি বছর হাজার টন কার্বন বায়ু থেকে সরিয়ে ভূগর্ভে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে তা আর বায়ুমণ্ডলে ফিরে না আসে।
সার্বিয়ায় "Liquid3" নামের এক অভিনব প্রকল্প শহুরে পরিবেশে ব্যবহার হচ্ছে। এটি দেখতে আধুনিক সড়ক বাতির মতো, কিন্তু ভিতরে থাকে একধরনের শৈবাল বা algae, যা CO₂ শোষণ করে অক্সিজেন উৎপাদন করে। শহরের ব্যস্ত এলাকাগুলোয় যেখানে গাছ লাগানো সম্ভব নয়, সেখানে Liquid3 এক ধরনের "সবুজ বিকল্প" হিসেবে কাজ করছে।
এইসব উদ্যোগ দেখিয়ে দিচ্ছে গাছের বিকল্প নয়, বরং সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবেই কৃত্রিম গাছ এখন বৈশ্বিক পরিবেশ নীতিতে জায়গা করে নিচ্ছে।
কৃত্রিম গাছের প্রযুক্তি মূলত তিনটি ধাপে কাজ করে
১। শোষণ
২। পৃথকীকরণ এবং
৩। সংরক্ষণ।
প্রথম ধাপে, গাছের মতো কাঠামোযুক্ত যন্ত্র বায়ুর সঙ্গে মিশে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইডকে একটি শোষক পদার্থে ধরে রাখে। দ্বিতীয় ধাপে, এই পদার্থকে উত্তপ্ত বা প্রক্রিয়াজাত করে কার্বন আলাদা করা হয়। তৃতীয় ধাপে, ওই কার্বন গ্যাসকে ভূগর্ভে পাঠানো হয় বা পুনরায় ব্যবহার করা হয়।
এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এই প্রক্রিয়াটি নিরবচ্ছিন্নভাবে করা যায়। অর্থাৎ যন্ত্রটি ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে পারে, দিনরাত নির্বিশেষে, এবং আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। তবে এটি পুরোপুরি টেকসই করতে হলে শক্তির উৎস হতে হবে নবায়নযোগ্য, যেমন সৌর বা বায়ু শক্তি। নাহলে এই যন্ত্রের নিজস্ব শক্তি ব্যয়ও আবার কার্বন নিঃসরণ বাড়াতে পারে।
সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার বাস্তব চিত্র-
প্রযুক্তি যতই আশাব্যঞ্জক হোক, বাস্তবায়নে রয়েছে বহু বাধা। প্রথমত, খরচ। বর্তমানে একটি কৃত্রিম গাছ স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল অর্থ লাগে। যে দেশগুলোর অর্থনীতি এখনো উন্নয়নশীল, তাদের জন্য এই প্রযুক্তি সরাসরি প্রয়োগ করা সহজ নয়। দ্বিতীয়ত, বৃহৎ পরিসরে প্রভাব ফেলতে হলে হাজার হাজার ইউনিট স্থাপন করতে হবে, যা জমি, শক্তি ও অবকাঠামোর দিক থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, যদিও এটি কার্বন ধরে রাখে, কিন্তু প্রকৃত গাছের মতো পানি সংরক্ষণ, মাটি রক্ষা বা জীববৈচিত্র্য বজায় রাখার ক্ষমতা নেই। তাই এই প্রযুক্তি কখনোই বন বা প্রকৃত গাছের বিকল্প হতে পারে না; বরং তাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করাই এর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
দক্ষিণ এশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও নদীভাঙনে প্রতি বছর বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। এই অঞ্চলে যদি ভবিষ্যতে কৃত্রিম গাছ প্রযুক্তি চালু করা যায়, তা হতে পারে পরিবেশ পুনরুদ্ধারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে বর্তমানে সৌর শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এই প্রযুক্তির জন্য উপযুক্ত শক্তির উৎস হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি স্থানীয়ভাবে সাশ্রয়ী কৃত্রিম কার্বন শোষণ প্রযুক্তি উন্নয়ন করতে পারে, তাহলে তা শুধু জলবায়ু মোকাবিলা নয়, নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থান তৈরির পথও খুলে দেবে। এছাড়া, ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে যেখানে গাছ লাগানোর জায়গা কম, সেখানে ছোট আকারের কৃত্রিম গাছ বা "কার্বন ক্যাপচার টাওয়ার" তৈরি করা গেলে তা দূষণ কমাতেও ভূমিকা রাখতে পারে।
মানুষের তৈরি যন্ত্র কখনো প্রকৃতির বিকল্প হতে পারে না,কিন্তু হতে পারে তার সহযোগী। কৃত্রিম গাছ প্রযুক্তি সেই সহযোগিতার উদাহরণ। এটি গাছের মতোই বাতাস পরিষ্কার করে, কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয়, বরং সহযোগিতাই টিকে থাকার একমাত্র পথ।
ভবিষ্যতের পৃথিবী হয়তো এমন হবে যেখানে শহরের ফুটপাথে, অফিস ভবনের ছাদে, কিংবা শিল্পাঞ্চলের পাশে সারি সারি কৃত্রিম গাছ দাঁড়িয়ে থাকবে দিনরাত নিরবভাবে বাতাস থেকে কার্বন শোষণ করছে। কিন্তু সেই সঙ্গে থাকবে প্রকৃত গাছের সবুজ সারি, থাকবে বনভূমি, থাকবে প্রকৃতির প্রাণস্পন্দন কারণ প্রযুক্তি একা নয়, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।