মস্তিষ্কের চুরির জাদু: অন্যের সামনে কেবল একটা হাই দিয়ে মন নিয়ন্ত্রনের পদ্ধতিগুলো শিখুন !

মস্তিষ্কের চুরির জাদু: অন্যের সামনে কেবল একটা হাই দিয়ে মন নিয়ন্ত্রনের পদ্ধতিগুলো শিখুন !
ছবির ক্যাপশান, মস্তিষ্কের চুরির জাদু: অন্যের সামনে কেবল একটা হাই দিয়ে মন নিয়ন্ত্রনের পদ্ধতিগুলো শিখুন !
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন কেউ আপনার পাশে হাই তুললেই আপনি নিজেও অজান্তে মুখ খুলে ফেলেন। এমনকি সিনেমায় বা টেলিভিশনে কারও হাই তোলার দৃশ্য দেখলেও অনেক সময় নিজের চোখ ভারী হয়ে আসে! কিন্তু কেন এমন হয়? অন্যের হাই দেখা মাত্র আমাদের হাই চলে আসে এর পেছনে লুকিয়ে আছে মানব মস্তিষ্কের গভীর সামাজিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক রহস্য।

এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলেন "Contagious Yawning", অর্থাৎ "সংক্রামক হাই"।

এটি সাধারণ হাই তোলার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রতিক্রিয়া যেখানে আমরা অন্য কাউকে হাই তুলতে দেখে বা শুনে নিজেদের অজান্তেই একই কাজ করি। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত মানুষের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ৫ থেকে ৭ সেকেন্ডের মধ্যেই। অর্থাৎ, অন্যের হাই দেখা মাত্র আমাদের মস্তিষ্ক খুব দ্রুত সেই আচরণ অনুকরণ করতে চায়।

কারণ ১: "মিরর নিউরন" মস্তিষ্কের অনুকরণকারী কোষ-

আমাদের মস্তিষ্কে আছে এক বিশেষ ধরনের কোষ, যেগুলোর নাম Mirror Neuron (আয়নার মতো নিউরন)। এই কোষগুলো এমনভাবে কাজ করে যে, অন্য কারও আচরণ আমরা দেখলে সেটি আমাদের মস্তিষ্কে "প্রতিফলিত" হয় যেন আমরা নিজেরাই তা করছি।যেমন- আপনি যদি কাউকে হাসতে দেখেন, আপনার মুখেও হাসি চলে আসে। কেউ ভয় পেলে আপনিও অজান্তে সতর্ক হয়ে যান। এই একই প্রতিক্রিয়া হাই তোলার ক্ষেত্রেও ঘটে। যখন অন্য কেউ হাই তোলে, আমাদের মস্তিষ্কের Mirror Neuron সিস্টেম তা অনুকরণ করে, ফলে আমাদেরও হাই চলে আসে।

কারণ ২: সহানুভূতি ও সামাজিক সংযোগ-

"সংক্রামক হাই" কেবল জৈব প্রতিক্রিয়া নয়, এটি সহানুভূতি ও সামাজিক সংবেদনশীলতার প্রতীকও। গবেষণা বলছে, যাদের মধ্যে Empathy (সহানুভূতি) বা সামাজিক বন্ধন বেশি, তাদের মধ্যে এই প্রতিক্রিয়া বেশি দেখা যায়। ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরিবার বা প্রিয়জনের হাই দেখে আমাদের হাই তোলার সম্ভাবনা অনেক বেশি। অপরিচিত বা অচেনা কারও ক্ষেত্রে তা কম।

এটি প্রমাণ করে, হাই শুধু শারীরিক ক্লান্তির নয়, মানসিক সংযোগেরও প্রকাশ।

কারণ ৩: মস্তিষ্কের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ-

অন্য এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলছে হাই তোলা আসলে মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার প্রাকৃতিক উপায়।

যখন আমরা ক্লান্ত, নিদ্রালু বা মানসিক চাপের মধ্যে থাকি, তখন মস্তিষ্কের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।

হাই তোলার মাধ্যমে

⇨ মুখ খুলে তাজা বাতাস ঢোকে,

⇨ রক্তপ্রবাহ বাড়ে এবং

⇨ মাথার ভেতরের তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়।

এভাবে অন্যের হাই দেখে আমাদের হাই তোলা একধরনের "তাপমাত্রা সিঙ্ক্রোনাইজেশন"। অর্থাৎ, দলের সবার মস্তিষ্ক যেন একসঙ্গে সতেজ ও সজাগ থাকে।

শিশুরা কেন কম হাই সংক্রমিত হয়?

গবেষণায় দেখা গেছে, ৪ থেকে ৫ বছর বয়সের নিচে শিশুরা সাধারণত অন্যের হাই দেখে প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কারণ, এই বয়সে তাদের মিরর নিউরন সিস্টেম ও সহানুভূতি বোধ সম্পূর্ণ বিকশিত হয় না। অর্থাৎ, "অন্যকে বুঝতে পারা" ক্ষমতা যত বাড়ে, সংক্রামক হাই তোলার প্রবণতাও তত বৃদ্ধি পায়।

শুধু মানুষ নয়, প্রাণীরাও করে হাই সংক্রমণ!

এটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়  বানর, কুকুর, এমনকি কিছু পাখির মধ্যেও দেখা গেছে একই প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে কুকুররা তাদের মালিকের হাই অনুকরণ করতে পারে যা মানব-প্রাণী সহানুভূতির অন্যতম প্রমাণ। এই ঘটনাকে প্রাণীবিজ্ঞানীরা বলেন "Cross-species Yawning Contagion" অর্থাৎ এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে হাই সংক্রমণ।

বিজ্ঞানীরা বলছেন হাই তোলা আসলে এক ধরনের সামাজিক যোগাযোগ সংকেত, যা দলের সদস্যদের মধ্যে মানসিক সমন্বয় ঘটায়। এটি এক অর্থে মস্তিষ্কের ভাষা, যা বলে "আমরা একসঙ্গে আছি, একে অপরের অবস্থার সঙ্গে যুক্ত।" তাই এটি কেবল ঘুমের ইঙ্গিত নয়, বরং মানব মস্তিষ্কের সামাজিক বিবর্তনের প্রমাণও।

অন্যের হাই দেখে আমাদের হাই চলে আসা এটি কোনো অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা নয়; এটি মানব মস্তিষ্কের সহানুভূতিশীল প্রকৃতির এক সূক্ষ্ম প্রকাশ। মিরর নিউরনের প্রতিফলন, সামাজিক সংযোগের প্রভাব এবং মস্তিষ্কের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সবকিছু মিলিয়ে এটি এক অনন্য জৈব-মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ, যখন আপনি কারও হাই দেখে হাই তুলছেন আপনি শুধু ক্লান্ত নন, আপনি আসলে মানবিক প্রতিক্রিয়ার এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন এবং সেটিই প্রমাণ করে, আমরা কেবল বুদ্ধিমান প্রাণীই নই, আমরা একে অপরের অনুভূতি "অনুভব" করতে সক্ষম জীব।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ