হঠাৎ রাগ, বাড়তি ওজন, চুল পড়া-সবকিছুর পেছনে কি লুকিয়ে আছে হরমোনাল ইমব্যালান্স!

হঠাৎ রাগ, বাড়তি ওজন, চুল পড়া-সবকিছুর পেছনে কি লুকিয়ে আছে হরমোনাল ইমব্যালান্স!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আমাদের শরীরের প্রতিটি কার্যকলাপ-ঘুম থেকে জেগে ওঠা, ক্ষুধা লাগা, রাগ বা আনন্দ, এমনকি প্রজনন ক্ষমতা-সবই নিয়ন্ত্রণে রাখে ক্ষুদ্র অথচ শক্তিশালী রাসায়নিক বার্তাবাহক, হরমোন। এগুলোকে অনেকেই বলেন শরীরের 'অদৃশ্য পরিচালক'। কিন্তু এই পরিচালক যদি ভারসাম্য হারায়, তখন শরীরজুড়ে ঘটে যায় অসংখ্য জটিলতা। এই অবস্থাকেই বলা হয় হরমোনাল ইমব্যালান্স বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।

হরমোন তৈরি হয় শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে-যেমন থাইরয়েড, অ্যাড্রিনাল, প্যানক্রিয়াস, ও ডিম্বাশয়/অণ্ডকোষ। এগুলো রক্তের মাধ্যমে ছড়িয়ে পুরো শরীরে বার্তা পাঠায়:

◑ কখন ঘুমাতে হবে, কখন জেগে উঠতে হবে,

◑ কখন খাবারের চাহিদা হবে,

◑ কেমন হবে মুড বা মানসিক অবস্থা,

◑ কখন বৃদ্ধি হবে বা প্রজনন প্রক্রিয়া সক্রিয় হবে।

অতএব, সামান্য হরমোন পরিবর্তনও শরীরে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
 

ভারসাম্যহীনতার প্রধান কারণ-

১. থাইরয়েডের সমস্যা: থাইরয়েড গ্রন্থি হরমোন বেশি (হাইপারথাইরয়েডিজম) বা কম (হাইপোথাইরয়েডিজম) উৎপাদন করলে ক্লান্তি, ওজন পরিবর্তন, হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে যায়।

২. পিসিওএস (Polycystic Ovary Syndrome): মহিলাদের ডিম্বাশয়ে ছোট ছোট সিস্ট তৈরি হলে ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরনের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে অনিয়মিত পিরিয়ড, ব্রণ, চুল পড়া দেখা দেয়।

৩. ডায়াবেটিস: ইনসুলিন নামের হরমোন সঠিকভাবে কাজ না করলে বা কম-বেশি হলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

৪. মানসিক চাপ (Stress): দীর্ঘদিনের স্ট্রেস কর্টিসল হরমোনকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেয়, যা ওজন বৃদ্ধি, ঘুমের সমস্যা ও মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে।

৫. অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা: পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, জাঙ্কফুড, ও শারীরিক কর্মকাণ্ডের অভাব হরমোন উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।

৬. মেনোপজ: নারীদের জীবনের স্বাভাবিক ধাপে ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরন হ্রাস পায়, যার ফলে হট ফ্ল্যাশ, অনিদ্রা, হাড় ক্ষয় প্রভৃতি উপসর্গ দেখা যায়।

 

লক্ষণ ও উপসর্গ- হরমোন ভারসাম্যহীনতার প্রভাব নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।

☞ ওজন পরিবর্তন: কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ ওজন বাড়া বা কমে যাওয়া।

☞ মেজাজের ওঠানামা: হরমোন সরাসরি মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারকে প্রভাবিত করে, ফলে উদ্বেগ, বিষণ্নতা বা খিটখিটে ভাব দেখা দিতে পারে।

☞ অনিয়মিত পিরিয়ড: নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চক্রের অনিয়ম হরমোন ইমব্যালান্সের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।

☞ অবসাদ ও ক্লান্তি: যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়ার পরও শরীর ক্লান্ত লাগে।

☞  ত্বক ও চুলের পরিবর্তন: ব্রণ, চুল পাতলা হয়ে যাওয়া বা অতিরিক্ত ঝরে পড়া।

☞ ঘুমের সমস্যা: কর্টিসল বা মেলাটোনিনের অস্বাভাবিকতা ঘুমকে প্রভাবিত করে।
 

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা নির্ণয় করা সহজ নয়, কারণ অনেক উপসর্গ অন্য রোগের সঙ্গে মিলে যায়। চিকিৎসকেরা সাধারণত করেন:

☞ রক্ত পরীক্ষা: থাইরয়েড হরমোন, ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন, ইনসুলিন বা কর্টিসল মাপা হয়।

☞ শারীরিক পরীক্ষা: ওজন, ত্বক, চুল, মাসিক চক্র বা অন্যান্য শারীরিক লক্ষণ মূল্যায়ন করা হয়।

 

চিকিৎসা ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন:

১. চিকিৎসা: হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (যখন প্রয়োজন)। থাইরয়েড বা ডায়াবেটিসের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ।
 

২. জীবনযাত্রার পরিবর্তন:

◑ পুষ্টিকর খাবার: শাকসবজি, বাদাম, বীজ, প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর চর্বি।

◑ নিয়মিত ব্যায়াম: হাঁটা, যোগব্যায়াম বা হালকা কার্ডিও ব্যায়াম হরমোনের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।

◑ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট: ধ্যান, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, যোগ বা অবসর সময় কাটানো।

◑ ঘুমের নিয়ম বজায় রাখা: পর্যাপ্ত ও নিয়মিত ঘুম হরমোন ভারসাম্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

◑ ওজন নিয়ন্ত্রণ: স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন অনেক হরমোনজনিত সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে।
 

হরমোনাল ইমব্যালান্স কেবল একটি 'ছোট সমস্যা' নয়-এটি ডায়াবেটিস, বন্ধ্যাত্ব, হৃদরোগ, হাড়ের ক্ষয়সহ দীর্ঘমেয়াদী গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই অল্প উপসর্গও হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।

শরীরের ভেতরে যে ক্ষুদ্র রাসায়নিক বার্তাবাহকরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে, তাদের ভারসাম্য রক্ষা করা মানে হলো পুরো শরীর ও মনের সুস্থতা রক্ষা করা। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ আর যথাযথ চিকিৎসাই পারে এই 'অদৃশ্য পরিচালককে' সঠিক পথে রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ