লাইক-শেয়ারের দৌড়- আত্মপরিচয় হারিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধাক্কা!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ডিজিটাল যুগে আমরা প্রায় সবাই এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছি। প্রতিদিন কোটি কোটি ছবি, ভিডিও, পোস্ট উঠে আসছে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক কিংবা ইনস্টাগ্রামে। এর মধ্যে কে কত লাইক, কমেন্ট, শেয়ার পেল—সেই হিসেব যেন আজকের মানুষের আত্মমর্যাদার নতুন মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে "ভাইরাল হতে হবে" মানসিকতা এক ধরনের সামাজিক চাপ তৈরি করছে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আত্মপরিচয়কেও বিকৃত করছে।
ভাইরাল হওয়ার মানসিক চাপ-
⇨ স্বীকৃতির তৃষ্ণা: অনেকে নিজের সৃজনশীলতা বা প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য কনটেন্ট তৈরি করলেও ভেতরে ভেতরে তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় দর্শকের প্রতিক্রিয়া পাওয়া।
⇨ অতিরিক্ত প্রত্যাশা: একটি ভিডিও বা পোস্ট ভাইরাল হলে পরেরবার আরও বড় ভাইরাল কনটেন্ট তৈরির চাপ তৈরি হয়। সেই চাপ পূরণ করতে না পারলে হতাশা, উদ্বেগ এবং আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়।
⇨ অন্যের সাথে তুলনা: "ওর ভিডিও লাখ ভিউ, আমারটা এত কম কেন?"—এ ধরনের তুলনা আত্মসম্মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং মানসিক অবসাদে ঠেলে দেয়।
পরিচয়ের বিকৃতি-
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার জন্য অনেকেই নিজেদের প্রকৃত সত্তা লুকিয়ে এমন এক "কৃত্রিম পরিচয়" গড়ে তোলেন, যা বাস্তবে তাদের চরিত্র বা জীবনযাত্রার সাথে মেলে না। কেউ অতিরঞ্জিত আবেগ প্রকাশ করে, কেউ অপ্রাসঙ্গিক বা ঝুঁকিপূর্ণ কনটেন্ট পোস্ট করে। অনেক সময় বাস্তব জীবনের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে ব্যক্তি নিজের আসল সত্তাকে চিনতে ভুল করে যায়। পরিচয়ের এই দ্বন্দ্ব দীর্ঘমেয়াদে মানসিক দ্বিধা, একাকিত্ব এবং আত্মসম্মানহীনতা তৈরি করতে পারে।
মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব-
⇨ ডোপামিন নির্ভরতা: প্রতিটি লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট মস্তিষ্কে এক ধরনের "ডোপামিন হিট" তৈরি করে। ধীরে ধীরে মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে, যেমন আসক্তি হয় নেশাজাতীয় দ্রব্যে।
⇨ অবিরাম অনিশ্চয়তা: "আমার পরের ভিডিও কেমন পারফর্ম করবে?"—এই অস্থিরতা উদ্বেগ এবং নিদ্রাহীনতার কারণ হয়।
⇨ সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: বাস্তব জীবনে সম্পর্কগুলো উপেক্ষিত হয়ে যায়। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আন্তরিক সময় কাটানোর পরিবর্তে স্ক্রিন-নির্ভরতা বেড়ে যায়।
সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব-
ভাইরাল হওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেক সময় বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়, যা দুর্ঘটনা ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো সহজ হয়ে যায়, কারণ লক্ষ্য থাকে শুধু প্রচার পাওয়া। ধীরে ধীরে একটি প্রজন্ম এমন এক মানসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, যেখানে "দেখানোর জন্য বেঁচে থাকা"-টাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
করণীয়-
⇨ ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি করা: স্কুল-কলেজ পর্যায়ে তরুণদের শেখানো দরকার যে ভাইরাল হওয়াই সাফল্যের মাপকাঠি নয়।
⇨ পরিবার ও বন্ধুর ভূমিকা: খোলামেলা আলাপ ও মানসিক সমর্থন দিতে হবে, যেন তরুণরা অনলাইন পরিচয়ের চেয়ে বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়।
⇨ স্বনিয়ন্ত্রণ: নির্দিষ্ট সময় পরে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার সীমিত করা এবং প্রয়োজন হলে ডিজিটাল ডিটক্সের মাধ্যমে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা জরুরি।
ভাইরাল হওয়ার মানসিক চাপ নিছক বিনোদন নয়; এটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মপরিচয়ে গভীর প্রভাব ফেলছে। আমরা যদি সচেতনভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার না করি, তবে নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলে এক ধরনের কৃত্রিম দুনিয়ায় বন্দি হয়ে যাব। ডিজিটাল যুগে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো মানুষ হিসেবে নিজেকে অটুট রাখা শুধু ভাইরাল হওয়ার জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলা নয়।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।