বিশ্বে এমন একটি স্থান আছে যেখানে মৃতদেহ পচে না-কারণ জানলে বিজ্ঞানও অবাক

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
উত্তর মেরুর খুব কাছে, নরওয়ের স্বালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের লংইয়ারবাইন-এক অদ্ভুত শহর। এখানে প্রচলিত অর্থে কবর দেওয়া যায় না; কফিনে শায়িত দেহ বরফে জমে বছরের পর বছর প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। তাই দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত এক 'মিথ'-এ শহরে নাকি মৃত্যুই নিষিদ্ধ। বাস্তবটা একটু ভিন্ন: আইনে মৃত্যু নিষিদ্ধ নয়; স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাকৃতিক কারণে কফিনে সমাধি দেওয়া নিষেধ, আর মৃত্যুপথযাত্রীদের সাধারণত নরওয়ের মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তর করা হয়। লংইয়ারবাইনের সরকারি পর্যটন কর্তৃপক্ষও এটিকে "আরবান মিথ" বলে স্পষ্ট করেছে। কফিনে সমাধি নিষিদ্ধ, তবে দীর্ঘদিনের বাসিন্দাদের অস্থিভস্মের কলস (urn) সমাধি অনুমোদিত।
দেহ কেন পচে না ??
লংইয়ারবাইনে মাটির নিচে রয়েছে পারমাফ্রস্ট-যে মাটি টানা কমপক্ষে দুই বছর ০°C বা তার নিচে থাকে। এই ঠান্ডা, শুষ্ক ও প্রায় জলশূন্য পরিবেশে অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে; পচনক্রিয়া মারাত্মক ধীর হয়। ওপরের 'অ্যাকটিভ লেয়ার' গ্রীষ্মে সামান্য নরম হলেও ভেতরের স্তরটা বরাবরই হিমায়িত থাকে। ফলে মৃতদেহ অল্প অক্সিজেন ও অল্প জলীয় পরিসরে 'সংরক্ষিত' অবস্থায় পড়ে থাকে—কখনও কখনও বছরকে দশকে টেনে দেয়।
এই বরফমাটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য ফ্রস্ট-হিভ: জমে-গলতে থাকা ওপরের স্তর কফিনকে ধীরে ধীরে ওপরে ঠেলে তুলতে পারে—যার বাস্তবিক ঝুঁকিই কফিন-সমাধি নিষিদ্ধের বড় কারণ। স্বালবার্ডে কফিন-সমাধি নিষিদ্ধের নিয়মে ঠিক এটিই বলা হয়েছে—মাটি বরফে জমে থাকার কারণে কফিন ও দেহ ওপরে উঠে আসার ঝুঁকি থাকে; তাই শুধু urn grave অনুমোদিত।
"মৃত্যু নিষিদ্ধ"-মিথের পেছনের প্রশাসনিক বাস্তবতা
লংইয়ারবাইন কোনো পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নগরী নয়; এখানে একটি ছোট আকারের জরুরি সেবা কেন্দ্রিক হাসপাতাল আছে। বড় অস্ত্রোপচার, প্রসব বা জটিল চিকিৎসার প্রয়োজন হলে রোগীদের ট্রম্সোসহ মূল ভূখণ্ডে পাঠানো হয়। এ কারণেই গুরুতর অসুস্থ, দীর্ঘমেয়াদি রোগী বা মৃত্যুপথযাত্রীদের সাধারণত দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে নেওয়া হয়-জনস্বাস্থ্য ও লজিস্টিক-দুটোই এখানে বিবেচ্য।
জন্মও কেন 'নিরুৎসাহিত'
আর্কটিকের এই শহরে পরিকল্পিত প্রসব-সুবিধা নেই; প্রসূতি বিভাগ, নবজাতক বিশেষজ্ঞসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অনুপস্থিত। ফলে গর্ভবতী নারীরা সাধারণত প্রসবের নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২–৩ সপ্তাহ আগে মূল ভূখণ্ডে চলে যান—এটা চিকিৎসা-প্রোটোকল ও এয়ারলাইনের নিরাপত্তা নীতির সম্মিলিত বাস্তবতা। জরুরি অবস্থা ছাড়া লংইয়ারবাইনে পরিকল্পিত প্রসব হয় না।
১৯১৮ সালের 'ফ্লু' ও লংইয়ারবাইনের শ্মশান-গল্প
এই শহরের পুরোনো কবরস্থানে ১৯১৮ সালের মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী কয়েকজন খনি–শ্রমিকের কবর আছে। ১৯৯৮ সালে এক আন্তর্জাতিক দল বরফে জমা টিস্যু নমুনা নিয়ে ভাইরাসের জিনগত চিহ্ন (RNA) খুঁজতে খনন চালায়। এখানে জীবন্ত ভাইরাস মেলেনি; বরং ভূতাত্ত্বিক জরিপে কবরের অবস্থান ও বরফস্তরের তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯১৮–এর ভাইরাসের জিনোম অধিকাংশই আলাস্কার ব্রেভিগ মিশনে বরফে জমা দেহ থেকে সংগৃহীত নমুনা দিয়ে উন্মোচিত হয়—এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের CDC–র বিস্তারিত নথি রয়েছে। অর্থাৎ, লংইয়ারবাইনের কবর বিজ্ঞানীদের সতর্ক করেছে বটে, কিন্তু 'বরফে জীবন্ত ভাইরাস' থাকার দাবি প্রমাণিত হয়নি।
জলবায়ু উষ্ণতা: সংরক্ষণ না হুমকি?
আর্কটিক এখন পৃথিবীর তুলনায় বহুগুণ দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে-স্বালবার্ডে শীতকালীন উষ্ণতার বাড়তি হার সবচেয়ে বেশি। এতে পারমাফ্রস্টের তাপমাত্রা বাড়ছে, 'অ্যাকটিভ লেয়ার' গভীরতর হচ্ছে; ঢাল-পাহাড় নড়বড়ে হয়ে ধস–হিমস্রোতের আশঙ্কা বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা ২০০৮ সাল থেকে লংইয়ারবাইনের কাছে জান্সোনহাওগেনসহ বিভিন্ন বোরহোলে পারমাফ্রস্ট পর্যবেক্ষণ করে এই উষ্ণতা–প্রবণতার প্রমাণ পেয়েছেন। ফলে, যে বরফ একসময় দেহকে 'সংরক্ষণ' করত, উষ্ণতায় সেটিই আবার পুরনো কবরস্থান ও অবকাঠামোর জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে-এ দ্বৈত বাস্তবতা এখন দৃশ্যমান।
'ব্যানড ডেথ' শিরোনামের ভেতরের সত্য সংক্ষেপে-
⇨ মারা যাওয়া আইনত অপরাধ নয়; এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা। কফিনে কবর দেওয়া নিষিদ্ধ, urn–সমাধি অনুমোদিত-এটাই নিয়ম।
⇨ গুরুতর অসুস্থ বা মৃত্যুপথযাত্রীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য মূল ভূখণ্ডে নেওয়া-এটি জনস্বাস্থ্য–নীতির অংশ।
⇨ পরিকল্পিত প্রসব লংইয়ারবাইনে হয় না; গর্ভবতীরা আগেভাগে মূল ভূখণ্ডে যান।
⇨ পারমাফ্রস্ট পচন ধীর করে; 'চিরকাল অপরিবর্তিত' নয়, তবে দীর্ঘায়ু সংরক্ষণ ঘটে-আর উষ্ণতা বাড়লে এ চিত্র বদলাচ্ছে।
লংইয়ারবাইন একধরনের প্রাকৃতিক 'ল্যাবরেটরি'—যেখানে জলবায়ু, ভূতত্ত্ব, জনস্বাস্থ্য আর ইতিহাস একই ফ্রেমে ধরা পড়ে। পারমাফ্রস্ট দেখায়, তাপমাত্রা–জল–মাইক্রোবায়োলজি মিলিয়ে পচন আসলে এক রাসায়নিক–জীববিজ্ঞানের সমীকরণ, যার গতি পরিবেশ বদলালেই বদলে যায়। কবর নিষিদ্ধের নিয়মটা তাই কুসংস্কার নয়; বরং ঠান্ডা মাথার বিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য আর ভূ-প্রকৃতির যুক্তি—যা এই আর্কটিক শহরের দৈনন্দিনতাকেই একটু আলাদা করে তুলেছে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।