বাইতুল হিকমাহ: আব্বাসীয় বাগদাদের সেই বাতিঘর, যেখানে মানবসভ্যতা খুঁজে পেয়েছিল জ্ঞানের নতুন মানচিত্র

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ইতিহাসে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো শুধু একটি সভ্যতার নয়, বরং পুরো মানবজাতির অগ্রগতির ইতিহাসে অনন্য মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আব্বাসীয় বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ ছিল তেমনই এক প্রতিষ্ঠান-যেখানে জ্ঞানের প্রতি অদম্য তৃষ্ণা, বিজ্ঞানের প্রতি সীমাহীন অনুসন্ধান আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন গড়ে তুলেছিল এক অনন্য বিশ্বকোষীয় ঐতিহ্য।
আব্বাসীয় খলিফারা বাগদাদকে কেবল রাজনৈতিক রাজধানী নয়, বরং এক বৌদ্ধিক কেন্দ্রে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। আল-মনসুর প্রাচীন পারস্যের বই-সংরক্ষণ পদ্ধতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন, যা ধীরে ধীরে খিজানাত আল-হিকমাহ নামে পরিচিত হয়। হারুন আল-রশিদের আমলে এটি জনসাধারণ ও পণ্ডিতদের জন্য আরও উন্মুক্ত হয়, কিন্তু প্রকৃত রূপান্তর ঘটে খলিফা আল-মামুনের হাতে।
৮১৩ থেকে ৮৩৩ সাল পর্যন্ত আল-মামুন শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, বিজ্ঞানেরও প্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনি বাইতুল হিকমাহকে লাইব্রেরি থেকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রে রূপ দেন। এখানে যুক্ত হয় পর্যবেক্ষণশালা-যেখানে আকাশ পর্যবেক্ষণ করে তৈরি হতো নতুন নতুন জ্যোতির্বিদ্যা তত্ত্ব। তাঁর নির্দেশে বিভিন্ন রাজ্য থেকে হাজার হাজার পুঁথি ও গ্রন্থ সংগৃহীত হয়। কিংবদন্তি অনুযায়ী, সিসিলির রাজকীয় লাইব্রেরি থেকে বই আনতে প্রায় ৪০০ উটের প্রয়োজন হয়েছিল। শুধু বই সংগ্রহই নয়, এখানে বই অনুবাদ ও পুনঃপ্রকাশে অনন্য ব্যবস্থা চালু হয়।
বাইতুল হিকমাহর এক অসাধারণ অবদান ছিল অনুবাদ আন্দোলন। গ্রীক, ল্যাটিন, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষার গ্রন্থগুলো আরবিতে রূপান্তরিত হতো। অনুবাদকদের এমন মর্যাদা দেওয়া হতো যে, অনূদিত গ্রন্থের ওজন সমান স্বর্ণ পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো। এর ফলে অ্যারিস্টটল, প্লেটো, ইউক্লিড, হিপোক্র্যাটস থেকে শুরু করে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের জ্ঞান আরব বিশ্বে প্রবাহিত হয়।
বাইতুল হিকমাহ কেবল একটি ভবন ছিল না; এটি ছিল মানব প্রতিভার এক মিলনকেন্দ্র।
জ্ঞানের বাতিঘরে যারা আলো জ্বালিয়েছিলেন তাঁরা হলেন-
☞ মুসা আল-খাওয়ারিজমি: বীজগণিতের জনক; তাঁর থেকেই "Algorithm" শব্দের উৎপত্তি।
☞ বনু মুসা ভ্রাতৃত্রয়: যন্ত্র প্রকৌশলে অসংখ্য উদ্ভাবন করেছিলেন।
☞ হুনায়ন ইবন ইশহাক: চিকিৎসাশাস্ত্রে হিপোক্র্যাটস ও গ্যালেনের গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করেন।
☞ আল-জাহিজ: প্রাণী ও পরিবেশ নিয়ে তাঁর গবেষণা আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রাথমিক সেতুবন্ধ।
☞ আল-মামুনের জ্যোতির্বিদরা: পৃথিবীর পরিধি মেপে এক যুগান্তকারী ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন।
এরা শুধু ইসলামি সভ্যতার অংশ ছিলেন না; তাঁদের কাজ ইউরোপীয় রেনেসাঁর জন্য জ্ঞানভাণ্ডার প্রস্তুত করে দেয়।
বাইতুল হিকমাহ এক অর্থে ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে আরবি, ফারসি, হিব্রু, সিরিয়াক, ল্যাটিন-সব ভাষার পণ্ডিত একত্র হতেন। খ্রিষ্টান, ইহুদি, মুসলিম-সবাই মিলেমিশে কাজ করতেন; বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রেই নয়, চিকিৎসা, দর্শন, ভূগোল, সাহিত্য-সব ক্ষেত্রেই গড়ে ওঠে বিশ্বমানের অবদান।
পরবর্তী কালে কর্ডোবা, টলেডো, কায়রোর বিশাল পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্রগুলো মূলত বাইতুল হিকমাহর অনুকরণে গড়ে ওঠে।
১২৫৮ সালে মঙ্গোলরা বাগদাদ দখল করলে বাইতুল হিকমাহ চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হয়। কথিত আছে, টাইগ্রিস নদীর পানি বইয়ের কালি মিশে কালো হয়ে গিয়েছিল। তবে কিছু অমূল্য পাণ্ডুলিপি রক্ষা পেয়ে পরে ইরানের মারাঘেহ অবজারভেটরিতে স্থানান্তরিত হয়।
তবুও, বাইতুল হিকমাহর উত্তরাধিকার মুছে যায়নি। ইউরোপে অনূদিত গ্রন্থগুলো থেকেই মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রম তৈরি হয় এবং বিজ্ঞানচর্চার নতুন যুগ শুরু হয়।
বাইতুল হিকমাহ প্রমাণ করে-মানব সভ্যতার আসল শক্তি অস্ত্র নয়, জ্ঞান। রাজনৈতিক উত্থান-পতনের বাইরে, এটি দেখিয়েছে কীভাবে কৌতূহল, গবেষণা ও সহযোগিতা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে।
আজকের দিনে, যখন জ্ঞান আবার বিভাজন ও সংকীর্ণতার শিকার হচ্ছে, বাইতুল হিকমাহর কাহিনী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবজাতি একসাথে কাজ করলে জ্ঞানের আলো সীমান্ত ছাড়িয়ে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।