অনার্স-মাস্টার্স বাদ দিয়ে কেন তরুণরা ছুটছে স্কিল ট্রেনিংয়ের দিকে!!

অনার্স-মাস্টার্স বাদ দিয়ে কেন তরুণরা ছুটছে স্কিল ট্রেনিংয়ের দিকে!!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল উচ্চশিক্ষা অর্জন অনার্স, মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি ডিগ্রি। সমাজে 'ভালো চাকরি' বা 'উজ্জ্বল ক্যারিয়ার'-এর সমীকরণে ডিগ্রিকে ধরা হতো মূল হাতিয়ার। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্টে যাচ্ছে সেই চিত্র। নতুন প্রজন্ম এখন প্রশ্ন তুলছে কেবল ডিগ্রি অর্জনই কি জীবনে সফল হওয়ার একমাত্র পথ? নাকি দক্ষতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতাই আসল মূলধন?

বর্তমান কর্মবাজারে বড় পরিবর্তন এসেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ব্লকচেইন, রোবটিকস, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন ও ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মতো খাতগুলোতে প্রচুর কাজ তৈরি হচ্ছে। এসব কাজের জন্য তাত্ত্বিক জ্ঞান কম, বরং হাতে-কলমে শেখা দক্ষতা বেশি প্রয়োজন।

একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ মিলিয়ন প্রচলিত চাকরি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, তবে একইসাথে ৯৭ মিলিয়ন নতুন স্কিলভিত্তিক চাকরি তৈরি হবে। অর্থাৎ, ভবিষ্যতের চাকরির বাজার একেবারেই দক্ষতা-নির্ভর হয়ে উঠছে।

মনোবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা বলছে মানুষের শেখার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো 'প্র্যাকটিক্যাল লার্নিং' বা কাজের মাধ্যমে শেখা। মস্তিষ্ক তখন দ্রুত তথ্য গ্রহণ করে, সংরক্ষণ করে এবং প্রয়োগ করতে পারে। ফলে কোনো বিষয়ে শুধুই বইপড়া বা পরীক্ষায় পাস করার চেয়ে হাতে-কলমে কাজ শিখে ফেলার প্রবণতাই বেশি স্থায়ী হয়।

 

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট- 

গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপলসহ অনেক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান স্পষ্ট করে জানিয়েছে তাদের কাছে ডিগ্রির কাগজের চেয়ে দক্ষতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক প্রজেক্টে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে, আবেদনকারীর মাস্টার্স বা পিএইচডি না থাকলেও চাকরির সুযোগ থাকে।
 

ইউরোপের কিছু দেশে যেমন-জার্মানি বা ফিনল্যান্ডে ভোকেশনাল ট্রেনিং ও স্কিল-বেইজড এডুকেশনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তরুণরা চাইলে মাধ্যমিকের পরই বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষায় যুক্ত হয়ে সরাসরি কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেন।
 

ভারতের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আইটি ও স্টার্টআপ ইন্ডাস্ট্রির কারণে লাখ লাখ তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত ডিগ্রির বাইরে গিয়ে স্বল্পমেয়াদি দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রামে যোগ দিচ্ছেন।

 

বাংলাদেশের বাস্তবতা- 

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু প্রচলিত উচ্চশিক্ষা শেষ করে তারা অনেকে হতাশায় ভোগেন, কারণ ডিগ্রি থাকলেও বাস্তব দক্ষতা না থাকায় চাকরি মেলে না। অন্যদিকে ফ্রিল্যান্সিং, আইটি সেবা, ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েশন বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে যারা কাজ করছেন, তাদের বেশিরভাগই স্কিল-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিয়েই সাফল্য পাচ্ছেন।

সরকারের আইসিটি ডিভিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ২য় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সার রপ্তানিকারক দেশ। এখানে কাজ করা বেশিরভাগ তরুণেরই প্রচলিত মাস্টার্স বা অনার্স ডিগ্রি নেই, কিন্তু দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তারা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন।

 

সমাজের মানসিকতা বদলাচ্ছে- 

আগে পরিবার ও সমাজ তরুণদের পড়াশোনায় শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি চাকরির দিকে ঠেলে দিত। কিন্তু এখন অনেকে বুঝতে পারছেন—একজন দক্ষ গ্রাফিক ডিজাইনার বা সফটওয়্যার ডেভেলপারও আর্থিক ও সামাজিকভাবে সমান সম্মানজনক অবস্থানে যেতে পারেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, একেবারে ডিগ্রি বাদ দিয়ে শুধু স্কিলের ওপর নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ উচ্চশিক্ষা মানুষের মধ্যে বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করে, যা শুধু স্কিলের মাধ্যমে আসে না। তাই ডিগ্রি ও দক্ষতার সমন্বয়ই তরুণদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পথ হতে পারে।

 

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা- 

⇨ চ্যালেঞ্জ: মানসম্মত স্কিল ট্রেনিং সেন্টারের অভাব, আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষক সংকট এবং সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া।
 

⇨ সম্ভাবনা: বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে স্কিলভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, তবে তরুণরা দেশীয় চাকরির অভাব পূরণ না করে বরং বৈশ্বিক শ্রমবাজারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবেন।

সংক্ষেপে বলা যায়, অনার্স বা মাস্টার্স ডিগ্রিকে একমাত্র সাফল্যের মানদণ্ড হিসেবে না দেখে তরুণরা এখন ভবিষ্যতের বাস্তবতাকে ধরতে চাইছেন। তারা জানেন ডিগ্রি নয়, দক্ষতাই আগামী দিনের টিকে থাকার চাবিকাঠি।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ