ফলের বাজারে আগুন—দোষ কার, প্রকৃতি নাকি অর্থনীতি!!

ফলের বাজারে আগুন—দোষ কার, প্রকৃতি নাকি অর্থনীতি!!
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

ফল একসময় ছিল প্রতিদিনের খাবারের অপরিহার্য অংশ। সকালের নাশতায় কলা, দুপুরে মৌসুমি আম, সন্ধ্যায় আপেল বা কমলার টুকরো—এ যেন ছিল সাধারণ পরিবারের নিয়মিত দৃশ্য। কিন্তু এখন বাজারে গেলে সেই দৃশ্য আর সহজে দেখা যায় না। কারণ ফলের ঝুড়ি আজ ক্রেতার কাছে বিলাসদ্রব্যের মতো মনে হচ্ছে। দাম এতটাই বেড়েছে যে অনেকেই ফল কেনার আগে হিসাব কষতে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রশ্ন হলো—কেন এভাবে ফলের দাম বাড়ছে? উত্তর লুকিয়ে আছে অর্থনৈতিক চাপ, পরিবেশগত পরিবর্তন এবং বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতায়।


ফলের দাম সরাসরি নির্ভর করে মৌসুমি সরবরাহের ওপর। যেমন—গ্রীষ্মকালে বাজারে আম ও লিচুর আধিক্য থাকে, শীতকালে কমলা। মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন দ্রুত কমে যায়। এই সময়ে সংরক্ষিত ফল বা আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘাটতি বাজারে দামের ঊর্ধ্বমুখী চাপ তৈরি করে।



ফল মূলত গ্রামাঞ্চলের বাগান থেকে শহরে আসে। পরিবহনের প্রতিটি ধাপে জ্বালানি তেলের খরচ বাড়ছে। ট্রাক ভাড়া বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলের কেজি দরে যুক্ত হয় অতিরিক্ত খরচ। অনেক সময় ফল নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে দ্রুত পরিবহনের জন্য বিক্রেতারা বাড়তি খরচ করেন, যা শেষে ভোক্তার ঘাড়েই পড়ে।



বাংলাদেশের বাজারে আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলার মতো ফলের বড় অংশই আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদন কমলে দাম বেড়ে যায়। তার ওপর ডলারের দাম বাড়লে আমদানিকারকদের খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। বন্দরে শুল্ক, কর এবং লজিস্টিক জটিলতা এই চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়। ফলে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত এসব বিদেশি ফলের দাম অনেক গুণ বেড়ে যায়।



দেশে আধুনিক কোল্ডস্টোরেজ ও গুদামের অভাব অন্যতম বড় সমস্যা। ফলে ফল সংরক্ষণ করা যায় না; একটি নির্দিষ্ট সময় পর নষ্ট হয়ে যায়। এতে বাজারে সরবরাহ কমে যায়, যা দাম বাড়ায়। আবার পাইকার, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতার স্তর যত বেশি, দামের ওপর চাপও তত বাড়ে।


প্রকৃতির অনিশ্চয়তাও ফল উৎপাদনে বড় বাধা। অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, খরা বা ঘূর্ণিঝড় অনেক ফলের মৌসুমি উৎপাদন কমিয়ে দেয়। যেমন—ফুল আসার সময় ঝড় হলে আম, লিচু বা কাঁঠালের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। উৎপাদন কমলে বাজারে দাম বাড়া অনিবার্য।


স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ার কারণে ফলের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে শহরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে আমদানি করা ফলের চাহিদা বেশি। সরবরাহ একই হারে না বাড়ায় দাম বেড়ে যায়।


বাংলাদেশের কৃষকরা প্রায়শই সরাসরি লাভবান হতে পারেন না। উৎপাদনের আসল দাম কৃষকের হাতে না পৌঁছালেও, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ভোক্তাকে অতিরিক্ত মূল্য দিতে হয়। পর্যাপ্ত বাজার তদারকি না থাকায় দামের নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না।




তুলনামূলক পরিসংখ্যান (২০২০–২০২৫):

গত পাঁচ বছরের বাজারচিত্র বলছে, দাম প্রায় প্রতি বছরই বেড়েছে।



⇨ আপেল: ২০২০ সালে ১৮০ টাকা, ২০২৫ সালে ৩০০/৩৫০  টাকা।


⇨ কলা (ডজন): ২০২০ সালে ৫০ টাকা, ২০২৫  সালে ৯০/১০০টাকা।


⇨ পেয়ারা: ২০২০ সালে ৬০ টাকা, ২০২৫ সালে ১২০ টাকা।


⇨ কমলা: ২০২০ সালে ১৫০ টাকা, ২০২৫ সালে ৩৫০/৪০০ টাকা।


অর্থাৎ, মাত্র পাঁচ বছরে অনেক ফলের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।





ফল কেবল একটি খাদ্য নয়, এটি স্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম প্রধান উপাদান। কিন্তু দামের লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ থেকে ফল ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ফলের বাজার স্থিতিশীল করতে হলে—

উৎপাদন বাড়াতে কৃষিকে সহায়তা,আধুনিক কোল্ডস্টোরেজ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি, পরিবহন খরচ কমানো, আমদানি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, বাজার তদারকি ও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমানো - এসব পদক্ষেপ জরুরি। না হলে "পুষ্টির ভান্ডার" নামে পরিচিত ফল সাধারণ মানুষের জন্য কেবল শখের জিনিস হিসেবেই থেকে যাবে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ