বিজ্ঞান কি বদলে দিচ্ছে চিকিৎসার খেলা? জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর বিপ্লব দেখুন!

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
মানুষের শরীরে লুকিয়ে থাকা ডিএনএ হলো জীবনের নকশা। এই ডিএনএ-র প্রতিটি ধাপে রয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন বেস পেয়ার, যা মিলে তৈরি করেছে সম্পূর্ণ মানব জিনোম। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে যখন এই নকশাকে একে একে পড়া হয়, সেই প্রক্রিয়াকে বলা হয় জিনোম সিকোয়েন্সিং। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রযুক্তি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ধারা আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে।
প্রচলিত পরীক্ষায় অনেক সময় রোগ নির্ণয়ে দীর্ঘ সময় লাগে। উদাহরণস্বরূপ-
⇨ বিরল জেনেটিক রোগ: অনেক শিশু জন্মগতভাবে এমন রোগে ভোগে যা সাধারণ পরীক্ষায় ধরা পড়ে না। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে দ্রুতই জানা যায় কোন জিনে ত্রুটি আছে।
⇨ ক্যানসার: ক্যানসারের ধরন আসলে জিনের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে। কোন কোষে কোন জিনের মিউটেশন ঘটেছে, তা জানা গেলে চিকিৎসা আরও নির্দিষ্টভাবে করা সম্ভব হয়।
⇨ সংক্রমণ রোগ: এমনকি ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেও জানা যায় সংক্রমণ কোন ধরণের জীবাণুর কারণে হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় এ প্রযুক্তি ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তে বড় ভূমিকা রেখেছে।
ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসার (Personalized Medicine) সূচনা-
একই ওষুধ একেকজন মানুষের শরীরে ভিন্নভাবে কাজ করে। কারণ তাদের জিন ভিন্ন।কারো ক্ষেত্রে একটি অ্যান্টিবায়োটিক খুব ভালো কাজ করলেও অন্য কারো শরীরে তেমন কাজ নাও করতে পারে।
ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কেমোথেরাপি ড্রাগও কারো শরীরে কার্যকর হয়, কারো আবার মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর মাধ্যমে আগে থেকেই অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে কোন ওষুধ কোন রোগীর জন্য সবচেয়ে উপযোগী হবে। ফলে চিকিৎসা হচ্ছে আরও ব্যক্তি–নির্ভর (Tailored Treatment), কমছে অকার্যকর ওষুধের ব্যবহার।
প্রথম মানব জিনোম সিকোয়েন্স করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৩ বছর, আর খরচ হয়েছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু বর্তমানে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং (NGS) প্রযুক্তির কারণে মাত্র কয়েক দিন বা সপ্তাহে একটি সম্পূর্ণ জিনোম পড়া সম্ভব হচ্ছে, আর খরচও নেমে এসেছে ১,০০০ ডলারের কাছাকাছি। গবেষকরা আশা করছেন ভবিষ্যতে এটি সাধারণ রক্ত পরীক্ষার মতো সহজ হয়ে যাবে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা:
⇨ নবজাতকের স্বাস্থ্য পূর্বাভাস: জন্মের পরই শিশুর জিনোম পড়ে জানা যাবে কোন কোন রোগের ঝুঁকি আছে। সেই অনুযায়ী আগাম সতর্কতা নেওয়া যাবে।
⇨ প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা: জেনেটিক ঝুঁকি চিহ্নিত করা গেলে অনেক রোগ আগেই ঠেকানো সম্ভব হবে।
⇨ বায়োটেকনোলজি ও ওষুধ উন্নয়ন: নতুন ওষুধ তৈরিতেও জিনোম সিকোয়েন্সিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, কারণ গবেষকরা জানবেন ঠিক কোন জিনকে লক্ষ্য করে ওষুধ তৈরি করতে হবে।
অবশ্য সবকিছুই শুধু ইতিবাচক নয়। রয়েছে চ্যালেঞ্জ ও নৈতিক প্রশ্নও-
⇨ খরচ: যদিও কমেছে, তবুও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ মানুষের নাগালে এখনো পৌঁছায়নি।
⇨ ডেটা সুরক্ষা: মানুষের জেনেটিক তথ্য খুবই ব্যক্তিগত। এগুলো ফাঁস হলে সামাজিক বৈষম্য বা বীমা–সংক্রান্ত সমস্যা তৈরি হতে পারে।
⇨নৈতিকতা: ভবিষ্যতে যদি কোনো নিয়োগকর্তা বা সংস্থা কর্মী নিয়োগের আগে জিনোম পরীক্ষা করতে চায়, তবে তা মানবাধিকারের জন্য হুমকি হতে পারে।
জিনোম সিকোয়েন্সিং শুধু রোগ শনাক্ত নয়, বরং চিকিৎসার নতুন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি চিকিৎসাকে করছে ব্যক্তিগত, নির্ভুল এবং কার্যকর। তবে এর সুফল সবার জন্য নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন খরচ কমানো, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা বৃদ্ধি ও কঠোর নৈতিক নীতি প্রণয়ন।
আগামী দিনে হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে নয়, জন্মের দিনই প্রতিটি শিশুর ডিএনএ পড়ে রাখা হবে—আর সেই তথ্যই হয়ে উঠবে সারা জীবনের স্বাস্থ্যসঙ্গী।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।