চেনা মানুষও যেন অচেনা! মুখমণ্ডল দৃষ্টি অগোচরে! জানুন অদ্ভুত রোগ 'প্রসোপ্যাগনোসিয়া'-এর রহস্য

চেনা মানুষও যেন অচেনা! মুখমণ্ডল দৃষ্টি অগোচরে! জানুন অদ্ভুত রোগ 'প্রসোপ্যাগনোসিয়া'-এর রহস্য
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

আজকের যুগে আমরা প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একে অপরকে সহজেই চিনতে পারি-কিন্তু কিছু মানুষের জন্য মুখ চিনতে পারা একদমই অসম্ভব। এমনই একটি অদ্ভুত ও জটিল রোগ হলো প্রসোপ্যাগনোসিয়া, যা সাধারণভাবে "ফেস ব্লাইন্ডনেস" নামেও পরিচিত। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থ চোখ, স্বাভাবিক স্মৃতি ও বুদ্ধিমত্তা থাকা সত্ত্বেও মানুষ চিনতে অক্ষম হন।

প্রসোপ্যাগনোসিয়া কী?

প্রসোপ্যাগনোসিয়া হলো একটি নিউরোলজিক্যাল অবস্থা, যেখানে মস্তিষ্কের সেই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা মুখ শনাক্ত করার কাজ করে। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি পরিচিত মুখও চিনতে অক্ষম হন। তীব্রতা অনুযায়ী, কেউ অল্প পরিচিত মুখ চিনতে পারেন না, আবার কেউ কেউ মুখ ও বস্তু আলাদা করতে ব্যর্থ হন।

গ্রীক ভাষা থেকে 'প্রসোপ্যাগনোসিয়া' শব্দটি এসেছে-"প্রসোপন" মানে মুখ এবং "অজ্ঞতা" মানে চেনার অক্ষমতা। মস্তিষ্কের ডান পার্শ্বীয় ফুসিফর্ম গাইরাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই রোগ দেখা দেয়। ফুসিফর্ম গাইরাস হলো মস্তিষ্কের সেই গুরুত্বপূর্ণ অংশ যা মুখ শনাক্তকরণ ও মুখমণ্ডল সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে।
 

প্রসোপ্যাগনোসিয়ার ধরন:

১. অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়া (Acquired Prosopagnosia):
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। পূর্বে স্বাভাবিকভাবে মুখ চিনতে পারতেন, কিন্তু স্ট্রোক, মাথা আঘাত বা অন্যান্য মস্তিষ্কজনিত সমস্যার কারণে ক্ষমতা হারান।
 

২. জন্মগত প্রসোপ্যাগনোসিয়া (Congenital Prosopagnosia):
জন্ম থেকেই থাকে। কোনো মস্তিষ্ক ক্ষতি নেই, স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা থাকা সত্ত্বেও মুখ শনাক্ত করতে অক্ষম। প্রায়শই বংশানুক্রমিক।
 

৩. ক্রমবিকাশমান প্রসোপ্যাগনোসিয়া (Developmental Prosopagnosia): শিশুকাল থেকে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। জন্মগত বা শৈশবের ক্ষতির কারণে হতে পারে।
 

এই রোগের সামাজিক প্রভাব- প্রসোপ্যাগনোসিয়া শুধু মুখ চিনতে অক্ষমতার সমস্যা নয়। এটি আক্রান্ত ব্যক্তির সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করে, এমনকি পরিবার, বন্ধু এবং কর্মক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। আক্রান্তরা প্রায়ই বিকল্প কৌশল-যেমন কণ্ঠস্বর, পোশাক, হাঁটার ধরন-নিয়ে মানুষ চিনার চেষ্টা করেন। তবে হঠাৎ পরিচিত মুখ দেখলে বা সাজ-পোশাক বদলালে সহজেই বিভ্রান্ত হন।

অনেক ক্ষেত্রে, সামাজিক উদ্বেগ (Social Anxiety) ও হতাশা, এমনকি ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে।

প্রসোপ্যাগনোসিয়ার বর্ণনা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। এরপর থেকে এ নিয়ে শতাধিক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি, হলিউড তারকা ব্র্যাড পিটও এই রোগের কথা স্বীকার করেছেন। তার মতে, এই রোগ শুধু মুখ চিনার সমস্যা নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনেও জটিলতা সৃষ্টি করে।
 

লক্ষণ ও শনাক্তকরণ:

১। পরিচিত মুখ চিনতে ব্যর্থতা

২। মুখমণ্ডল না দেখে মানুষ চিনার চেষ্টা (চুলের ধরন, চলাফেরা, পোশাক)

৩। টেলিভিশন বা সিনেমার চরিত্র শনাক্ত করতে সমস্যা

৪। আয়নায় নিজের মুখও চিনতে না পারা

৫। শিশুদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করতে পারেন-জনসমক্ষে আত্মবিশ্বাসের অভাব, বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে অসুবিধা, পরিচিতজনকে ভুলে যাওয়া ইত্যাদি।
 

রোগ নির্ণয়: চিকিৎসকরা নির্ণয় করেন-

⇨ পরিচিত ও অপরিচিত মুখ শনাক্তের পরীক্ষা
 

একাধিক মুখের ছবি থেকে মিল ও অমিল নির্ণয়

⇨ বিখ্যাত ব্যক্তির মুখ চিনার পরীক্ষা

⇨ মস্তিষ্কের ইমেজিং (MRI, fMRI)

⇨ শিশুদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা হয়-পরিচিত মুখ চিনতে ব্যর্থতা, জনসমক্ষে ঘেঁষে থাকা, নাটক বা সিনেমার চরিত্র বোঝার অসুবিধা।

 

চিকিৎসা ও সহায়তা: এ পর্যন্ত কার্যকরী স্থায়ী চিকিৎসা নেই। তবে সহায়ক উপায়গুলো হলো-

⇨ মুখ চিনার বিকল্প কৌশল শেখানো (কণ্ঠস্বর, পোশাক, চলাফেরা)

⇨ প্রশিক্ষণ ও থেরাপি

⇨ মস্তিষ্ক পুনর্বাসন (অর্জিত রোগে)

⇨ গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সফটওয়্যার ব্যবহার করে নতুন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি তৈরি করছেন।

 

গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি ৫০ জনে একজন ক্রমবিকাশমান প্রসোপ্যাগনোসিয়ায় আক্রান্ত। শুধু যুক্তরাজ্যেই আনুমানিক ১৫ লক্ষ মানুষ এ সমস্যায় ভুগছেন। বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন স্ট্রোক বা মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের মধ্যে এটি তুলনামূলক বেশি।

প্রসোপ্যাগনোসিয়া ও অটিজম- অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে অনেক শিশুর মুখ চিনার সমস্যা দেখা যায়। তবে এটি প্রসোপ্যাগনোসিয়ার সমান নয়। প্রকৃতপক্ষে, কিছু ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় ভুল হয়ে যায় এবং প্রসোপ্যাগনোসিয়াকে উচ্চমাত্রার অটিজম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

প্রসোপ্যাগনোসিয়া হলো একটি অদৃশ্য, কিন্তু গভীর প্রভাব ফেলা রোগ, যা ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবন, সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে জটিল করে তোলে। গবেষকরা বিশ্বব্যাপী এই রোগের কারণ ও চিকিৎসা খুঁজে বের করার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, এবং আশা করা যায় ভবিষ্যতে আরও কার্যকর সমাধান উদ্ভাবিত হবে।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ