মানুষ যখন নিজেকে নেকড়ে মনে করে -ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপি'র অদ্ভুত, বিরল ও বৈজ্ঞানিক রহস্য

মানুষ যখন  নিজেকে নেকড়ে মনে করে -ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপি'র অদ্ভুত, বিরল ও বৈজ্ঞানিক রহস্য
  • Author,
  • Role, জাগরণ নিউজ বাংলা

মানুষের মস্তিষ্ক পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল জৈবযন্ত্র। কিন্তু যখন এই মস্তিষ্ক বাস্তবতা আর কল্পনার সীমা গুলিয়ে ফেলে, তখন জন্ম নেয় কিছু অবিশ্বাস্য ব্যাধি। এর মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় ও বিরল এক অবস্থা হলো ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপি -যেখানে একজন মানুষ বিশ্বাস করেন যে তিনি প্রাণীতে, বিশেষত নেকড়েতে, রূপান্তরিত হয়েছেন বা হচ্ছেন।

শব্দের উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট:

"লিসেনথ্রপি" শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক থেকে-Lycos (নেকড়ে) এবং Anthropos (মানুষ)। যদিও লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনিতে নেকড়ে মানুষ বা Werewolf বহু আগে থেকেই রয়েছে, তবে ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপি সম্পূর্ণভাবে একটি মনোরোগজনিত অবস্থা,  যার সঙ্গে বাস্তবে শারীরিক রূপান্তরের কোনো সম্পর্ক নেই।
 

ইতিহাসে লিসেনথ্রপি:

⇨ মধ্যযুগীয় ইউরোপ : তৎকালীন সময়ে অনেক মানুষকে "নেকড়ে মানুষ" বলে ডাইনিবিদ্যা বা শয়তানি কার্যকলাপে অভিযুক্ত করা হতো। পরবর্তীতে ধারণা হয়, এদের অনেকেই হয়তো ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপিতে ভুগছিলেন।

⇨ প্রাচীন চিকিৎসা নথি : ১৮ ও ১৯ শতকে ইউরোপের মানসিক চিকিৎসকরা কয়েকটি নথিভুক্ত কেস লিপিবদ্ধ করেছিলেন যেখানে রোগীরা নেকড়ে বা কুকুরে রূপান্তরের অনুভূতি জানিয়েছিলেন।

⇨আধুনিক কেস : ২০ শতক থেকে মনোরোগবিদ্যা এই রোগকে 'Delusional Misidentification Syndrome'-এর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে।
 

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ-

১. স্নায়ুবিজ্ঞানের দিক থেকে: মস্তিষ্কের সোমাটোসেন্সরি কর্টেক্স শরীরের অনুভূতি ও চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে কার্যকলাপের অস্বাভাবিকতা থাকলে একজন ব্যক্তি নিজের শরীরের আকার, গঠন বা সত্তা নিয়ে বিভ্রমে পড়তে পারেন। ফ্রন্টাল লোব ও টেম্পোরাল লোবের কিছু অংশে স্নায়বিক সংকেতের ভারসাম্য নষ্ট হলে এ ধরনের ভুল সনাক্তকরণ (Misidentification) দেখা দিতে পারে।
 

২. মনোবিজ্ঞানের দিক থেকে: এটি মূলত এক ধরনের সাইকোটিক ডিসঅর্ডার , যেখানে রোগী শুধু বিশ্বাসই করেন না, বরং প্রাণীর মতো আচরণও শুরু করে দেন-হাঁক ধরা, গর্জন, চার হাত-পায়ে হাঁটা, দাঁত কামড়ানো ইত্যাদি।

কখনও এটি স্কিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, তীব্র ডিপ্রেশন বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) -এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেখা দেয়।
 

লক্ষণ:

১।  নিজের শরীর প্রাণীর মতো হয়ে যাচ্ছে বলে দৃঢ় বিশ্বাস

২। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকার বদলাচ্ছে বলে অনুভব করা

৩। প্রাণীর শব্দ ও আচরণ নকল করা

৪। সামাজিক মেলামেশা এড়িয়ে চলা

৫। বিভ্রম ও বাস্তবতা পৃথক করতে অক্ষমতা
 

চিকিৎসা ও সমাধান: যেহেতু এটি মানসিক ব্যাধি, চিকিৎসায় মূলত ব্যবহৃত হয়:

১। সাইকোথেরাপি – বিভ্রম ভাঙা ও বাস্তবতার ধারণা ফিরিয়ে আনা

২। কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) – নেতিবাচক চিন্তা ও আচরণ পরিবর্তন

৩। ঔষধ – প্রয়োজনে অ্যান্টিসাইকোটিক বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ

৪। স্নায়ুবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা – মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে আধুনিক থেরাপি
 

এই রোগের বিরলতা ও অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য একে জনপ্রিয় সংস্কৃতি, সিনেমা ও বইয়ের গল্পে স্থান দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আক্রান্তরা মারাত্মক সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মানসিক কষ্ট ও ভুল বোঝাবুঝির শিকার হন।

ক্লিনিক্যাল লিসেনথ্রপি শুধু একটি মনোরোগ নয়-এটি মানুষের মস্তিষ্কের সীমাহীন জটিলতার প্রতিফলন। বিজ্ঞানের উন্নতি আমাদের এই ব্যাধির রহস্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করছে, তবে এটি এখনো মনে করিয়ে দেয়-মানুষের মন মাঝে মাঝে এমন জগতে প্রবেশ করে যা কল্পনার থেকেও বেশি অদ্ভুত।

আপনার প্রতিক্রিয়া জানান

❤️
Love
0
(0.00 / 0 total)
👏
Clap
0
(0.00 / 0 total)
🙂
Smile
0
(0.00 / 0 total)
😞
Sad
0
(0.00 / 0 total)

মন্তব্যসমূহ

এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।


সম্পর্কিত নিউজ