মস্তিষ্ক কি সত্যিই ট্রমাকে ভুলে যেতে পারে? জানুন স্মৃতি ও যন্ত্রণার অবিশ্বাস্য সংঘর্ষ

- Author,
- Role, জাগরণ নিউজ বাংলা
ট্রমা শুধু একটি ঘটনা নয়-এটি একটি মানসিক, আবেগীয় এবং স্নায়ুবৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতা, যা একজন মানুষের জীবন, আচরণ ও চিন্তাধারাকে বদলে দিতে পারে। প্রশ্ন হলো-মস্তিষ্ক কি এই যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি মুছে ফেলতে সক্ষম, নাকি তা কেবল গভীরে চাপা পড়ে থাকে, সুযোগ পেলেই বাস্তবতার সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়?
স্মৃতির কার্যপ্রণালী ও ট্রমার প্রভাব-
মানুষের স্মৃতির প্রধান নিয়ন্ত্রক অংশ হলো হিপোক্যাম্পাস ও অ্যামিগডালা।
⇨ হিপোক্যাম্পাস: ঘটনা ও তথ্যের সময়-প্রেক্ষাপট সংরক্ষণ করে।
⇨ অ্যামিগডালা : ভয়ের মতো আবেগ সংরক্ষণ ও সক্রিয় করে।
ট্রমা ঘটলে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল ও নরএপিনেফ্রিন হঠাৎ বেড়ে যায়, যা মস্তিষ্কে তথ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে বদলে দেয়। ফলে কিছু স্মৃতি অত্যন্ত তীব্রভাবে মনে গেঁথে যায়, আবার কিছু অংশ খণ্ডিত হয়ে হারিয়ে যায়।
ট্রমা-সংক্রান্ত স্মৃতির তিনটি রূপ-
১. ইন্ট্রুসিভ মেমোরি (Intrusive Memory):
⇨ হঠাৎ করে স্পষ্ট চিত্র বা অনুভূতি মনে ভেসে ওঠা।
⇨ PTSD রোগীদের মধ্যে এটি সবচেয়ে সাধারণ।
২। রিপ্রেসড মেমোরি (Repressed Memory):
⇨ মস্তিষ্ক অবচেতনভাবে স্মৃতিকে চাপা দিয়ে রাখে, যাতে তা চেতনায় না আসে।
⇨ এটি পুরোপুরি মুছে যায় না, শুধু 'লক' হয়ে যায়।
৩। ডিসোসিয়েটেড মেমোরি (Dissociated Memory):
⇨ ঘটনার ধারাবাহিকতা হারিয়ে যায়, খণ্ডিত অংশ মনে থাকে।
⇨ অনেক সময় ট্রমার মুহূর্তে মানুষ বাস্তবতা থেকে 'ডিটাচ' হয়ে যায়।
যখন দমিয়ে রাখা স্মৃতি বা ট্রিগার হঠাৎ সক্রিয় হয়-যেমন কোনো গন্ধ, শব্দ বা দৃশ্য-তখন মস্তিষ্ক 'ফ্ল্যাশব্যাক' তৈরি করে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করেন, তিনি যেন আবার সেই ঘটনাটির ভেতর ফিরে গেছেন। এটি শুধু আবেগ নয়, বরং শরীরে শারীরিক প্রতিক্রিয়াও তৈরি করতে পারে-হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘাম, শ্বাসকষ্ট।
নিউরোসায়েন্স দেখাচ্ছে, ট্রমা মস্তিষ্কের নিউরাল পথ (neural pathway) বদলে দেয়।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি -র গবেষণায় পাওয়া গেছে, দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা হিপোক্যাম্পাসের আকার ছোট করে দিতে পারে, ফলে নতুন স্মৃতি সংরক্ষণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।
EMDR ও কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT)_এর মাধ্যমে ট্রমার আবেগীয় তীব্রতা কমানো সম্ভব হলেও ঘটনার স্মৃতি পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না।
ট্রমা মোকাবিলা ও চিকিৎসা পদ্ধতি:
➤ থেরাপি ভিত্তিক চিকিৎসা
⇨ EMDR
⇨ CBT
⇨ এক্সপোজার থেরাপি
➤ ঔষধ ভিত্তিক চিকিৎসা
⇨ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট
⇨ অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি মেডিসিন
➤ সামাজিক ও আবেগীয় সহায়তা
⇨ নিরাপদ পরিবেশ
⇨ সমর্থনমূলক সম্পর্ক
⇨ সাপোর্ট গ্রুপ
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ-
⇨ যুদ্ধফেরত সৈন্যদের মধ্যে PTSD প্রথম বড় আকারে নথিভুক্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, তখন একে "শেল শক" বলা হতো।
⇨ প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে ট্রমাজনিত 'উন্মাদনা' নিয়ে লেখালিখি ছিল, যদিও তখন এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানা ছিল না।
মস্তিষ্ক অনেক সময় বাস্তব ঘটনার সঙ্গে মিশিয়ে 'পরিবর্তিত স্মৃতি' তৈরি করে, যা আংশিক সত্য আর আংশিক কল্পনা। ফলে একজন মানুষ তার ট্রমার আসল চেহারার চেয়ে ভিন্ন রূপ মনে রাখতে পারে-এটাই স্মৃতি ও বাস্তবতার সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ।
ট্রমার স্মৃতি পুরোপুরি মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব, তবে সঠিক চিকিৎসা, থেরাপি এবং সহায়তার মাধ্যমে তার যন্ত্রণা ও প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়। ট্রমা আমাদের শেখায়-মস্তিষ্ক শুধু স্মৃতির ভাণ্ডার নয়, বরং পরিবর্তনের এক আশ্চর্য ক্ষমতাও রাখে।
আপনার প্রতিক্রিয়া জানান
মন্তব্যসমূহ
এই সংবাদের জন্য এখনো কোনো মন্তব্য নেই।